কভিড-১৯ পজিটিভ হয়ে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব শাহানা আক্তার প্রায় এক মাস রাজধানীর দুটি বেসরকারি করোনা বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এরপর সর্বশেষ ১৪ দিন ধরে সরকারি একটি কভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ভর্তি তিনি। শুরু থেকেই সংকটাপন্ন অবস্থা থাকায় তাকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। ভর্তি হওয়ার পর তাকে রেমডিসিভির ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল। ছয় ডোজের ইনজেকশন দেয়ার ক্ষেত্রে তাকে প্রথম দিন দুই ডোজ ও পরের চারদিন এক ডোজ করে দেয়া হয়। তবে এখনো তার অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি।
বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেলে অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডিসিভিরের প্রয়োগ শুরু হয়। মূলত ২০১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা সংকটের সময় তৈরি হয় ওষুধটি। করোনা মহামারীতে একাধিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে কভিড-১৯ পজিটিভ রোগীদের সম্ভাব্য চিকিৎসার ওষুধ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয় একে। বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা কভিড রোগীদের ওপর এ ওষুধ প্রয়োগের অনুমোদন দেয়। যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলেছে, এ ওষুধ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসার ফলাফলে তেমন উন্নতি ঘটাতে পারেনি।
তবে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও করোনা রোগীদের চিকিৎসায় রেমডিসিভির প্রয়োগ করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এ ওষুধ প্রয়োগের ফলে সংকটাপন্ন রোগীদের সুস্থ হওয়ার হার আশাব্যঞ্জক নয়। উল্টোদিকে এর প্রয়োগের কারণে শাহানা আক্তারের মতো রোগীদের হাসপাতালে থাকার দিন দীর্ঘায়িত হচ্ছে বলে সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে।
দ্য জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (জামা) ১৫ জুলাই এ-সংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করে। অ্যাসোসিয়েশন অব রেমডিসিভির ট্রিটমেন্ট উইথ সারভাইভাল অ্যান্ড লেন্থ অব হসপিটাল স্টে অ্যামং ইউএস ভেটেরান্স হসপিটালাইজড উইথ কভিড-১৯ শীর্ষক ওই গবেষণায় রেমডিসিভির প্রয়োগের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে।
গবেষণাটি বলছে, রেমডিসিভির কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য কোনো ক্লিনিক্যাল সুবিধা দেয় না। অনেকের ক্ষেত্রে এটি শুধু হাসপাতালে থাকার সময় বাড়িয়ে দেয়। ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসার জন্য যেসব রোগীর ওপর রেমডিসিভির প্রয়োগ করা হয়েছে, তারা ছয়দিন হাসপাতালে অবস্থান করেছেন। আর যারা এ ওষুধ নেননি, তারা তিনদিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। করোনা রোগীদের ক্ষেত্রেও এমনটি দেখা গেছে। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা অন্য কোনো সমস্যার জন্য নয়, বরং রেমডিসিভিরের কোর্স শেষ করার জন্য রোগীদের বেশি সময় হাসপাতালে রাখতে হয়েছে।
হাসপাতালে ভর্তির ৩০ দিনের মধ্যে ২৬৭ জন করোনা রোগী মারা গেছেন। যাদের মধ্যে ১৪৩ জনকে (১২ শতাংশ) রেমডিসিভির ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল বলে ওই প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে। রেমডিসিভির প্রয়োগ শেষ করার জন্য হাসপাতালে থাকতে হয়েছে বেশির ভাগ রোগীকে। যদিও তারা হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। গবেষকরা আশঙ্কা করছেন, রেমডিসিভির প্রয়োগের কারণে করোনা চিকিৎসা দেয়া হাসপাতালগুলোকে শয্যা সংখ্যা বাড়াতে হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন কর্তৃপক্ষ (এফডিএ) হাসপাতালগুলোতে রেমডিসিভির ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে। তবে করোনায় আক্রান্ত হয়ে যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়েছে, তাদের ওপরই কেবল এ ওষুধ প্রয়োগের জন্য বলা হয়। যেসব রোগীর শ্বাসকষ্ট হয় বা অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়ে ভেন্টিলেটরে নেয়া হয়, শুধু তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে বলেছে এফডিএ। একই সঙ্গে জটিল সমস্যাযুক্ত রোগীদের জন্য এ ওষুধ প্রয়োগ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের এ গবেষণার জন্য হাসপাতালে ভর্তি ছয় হাজার করোনা রোগীকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশের ওপর রেমডিসিভির প্রয়োগ করা হয়েছিল। প্রথমে ২০০ মিলিগ্রাম ও পরে ১০০ মিলিগ্রাম করে পাঁচ বা ১০ দিনে এ ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। তাদের বেশির ভাগই ষাটোর্ধ্ব। গবেষণা বলছে, রেমডিসিভির প্রয়োগের কারণে ষাটোর্ধ্বদের বেশির ভাগেরই হূিপণ্ড ও ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে আটটি ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রেমডিসিভির উৎপাদন করছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, নভেল করোনাভাইরাসের বিপক্ষে এটি একমাত্র কার্যকরী ওষুধ হিসেবে প্রমাণ মিলেছে। তবে রেমডিসিভিরকে নভেল করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে একমাত্র ওষুধ হিসেবে প্রচারের বিষয়টিতে দ্বিমত পোষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, রেমডিসিভির প্রয়োগের ফলে রোগীরা দ্রুত সুস্থ হচ্ছেন—এমনটি শুরুতে বলা হলেও এখন তার প্রমাণ মিলছে না। রেমডিসিভির মৃত্যু কমাতে কার্যকরী ওষুধ নয়। এ ওষুধের ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা খারাপ পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে। রেমডিসিভির প্রয়োগের বিষয়ে পর্যাপ্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ না হওয়ায় এখনই সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে না।
দীর্ঘদিন সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের চিকিৎসা করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে শুধু ক্রিটিক্যাল অবস্থায় যায়, তাদেরই এ ওষুধ দেয়া হয়। যাদের অক্সিজেন লেভেল কমে যান, তারাই এ ওষুধ পেয়ে থাকেন। তবে কিডনি, লিভারসহ কিছু জটিল সমস্যা থাকলে রেমডিসিভির প্রয়োগ করা হয় না। বেসরকারি হাসপাতালে রেমডিসিভিরের বেশি প্রয়োগ হলেও সরকারি হাসপাতালে এর সুযোগ কম। কেননা সরকারি সরবরাহের কথাও বিবেচনা করা হয়। তবে রোগীর ক্ষতি হবে না এমন বিবেচনা করে আমরা রেমডিসিভির প্রয়োগ করে থাকি।
করোনা রোগীর ব্যবস্থাপনায় সরকার প্রণীত জাতীয় গাইডলাইন ন্যাশনাল গাইডলাইনস অন ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট অব কভিড-১৯-এর সর্বশেষ সংস্করণে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় রেমডিসিভির প্রয়োগের বিষয়টি বলা হয়েছে। সেখানে দুই পর্যায়ের (মধ্যম ও গুরুতর) রোগীর ক্ষেত্রে এ ওষুধ প্রয়োগ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। করোনা পজিটিভ হয়ে হাসপাতালে ভর্তির নির্দিষ্ট দিন পর যাদের অক্সিজেন স্যাচুরেশন বা অক্সিজেন প্রবাহ কমে যায়, শ্বাসকষ্ট বাড়ে ও বেশি মাত্রার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, তাদের ক্ষেত্রে রেমডিসিভির প্রয়োগের কথা বলা হয়েছে। এজন্য পাঁচদিনে ছয় ডোজ ও ১০ দিনে ১১ ডোজ রেমডিসিভির প্রয়োগের কথা বলা হয়।
তবে সংকটাপন্ন রোগীদের ওপর রেমডিসিভির প্রয়োগের ফলাফল তেমন ভালো নয় বলে জানিয়েছেন দেশের চিকিৎসকরা। দেশে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন থাকলেও তা পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট পর্ষদ নেই মন্তব্য করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এমএ ফায়েজ বণিক বার্তাকে বলেন, সব ওষুধেরই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। রেমডিসিভির প্রয়োগের ক্ষেত্রেও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। এ ওষুধ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সরকারি গাইডলাইন রয়েছে। তবে গাইডলাইন থাকলেই হবে না, সরকারকে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। অতি সংবেদনশীল এ ওষুধ কীভাবে ও কোন পরিসরে প্রয়োগ করা হচ্ছে তা দেখতে হবে। তবে এসব পর্যবেক্ষণের জন্য নির্দিষ্ট কেউ নেই। রেমডিসিভির ব্যবহারে যেমন সুবিধা রয়েছে, ঠিক তেমনি কিছু অসুবিধাও রয়েছে বলে মনে করেন মেডিসিনের এ অধ্যাপক।