সরকারি আরটি পিসিআর পরীক্ষাগার নেই ৩৬ জেলায়

কুড়িগ্রামের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাত করি রায় নিলু। দেহে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সন্দেহে গত ৮ জুলাই সদর উপজেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় নমুনা দেন। ১০ দিন পর তিনি পরীক্ষার ফলাফল হাতে পান। তিনি কভিড-১৯ পজিটিভ বলে উল্লেখ করা হয়। শুধু নিলুই নন। কুড়িগ্রামের বাসিন্দারা নমুনা দেয়ার ১০-১৫ দিন পর আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ফলাফল পাচ্ছেন। এতে পজিটিভ হলেও ফলাফল আসতে দেরি হওয়ায় সংক্রমণ বিস্তার ঠেকাতে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না।

এভাবে দেশের ৩৬টি জেলায় করোনা পরীক্ষার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পরিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন বা আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার নেই। এসব জেলায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনাও পিছিয়ে রয়েছে। ফলে করোনা পরীক্ষার জন্য র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট এবং জিন এক্সপার্টের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। জিন এক্সপার্টের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা কম। আর র্যাপিড অ্যান্টিজেন পদ্ধতির পরীক্ষা শতভাগ নির্ভুল না হওয়ায় চূড়ান্ত পর্যায়ে নমুনাগুলো আরটি-পিসিআরে নিরীক্ষা করা হয়। জেলাগুলোতে আরটি-পিসিআর না থাকায় নমুনা বিভাগীয় শহর বা রাজধানীতে পাঠাতে হয়। এতে নমুনা দেয়া ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন কিনা তা জানাতে বিলম্ব হয়। আর এ সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার অভাবে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে ৫৩টি জিন এক্সপার্ট, ৫৩৩টি র্যাপিড অ্যান্টিজেন ও ১৩৩টি আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি আরটি-পিসিআরের সংখ্যা ৫৫টি। দেশের সব জেলায় এখনো আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার স্থাপন করতে পারেনি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। বেশির ভাগ পরীক্ষাগারের অবস্থানই রাজধানী ও বিভাগীয় শহরে। ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলার মধ্যে মাদারীপুর, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও টাঙ্গাইল জেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার নেই। চট্টগ্রামের ১১ জেলার মধ্যে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চাঁদপুর; ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলার মধ্যে নেত্রকোনা ও শেরপুর; রাজশাহী বিভাগের আট জেলার মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও জয়পুরহাট; রংপুর বিভাগের আট জেলার মধ্যে পঞ্চগড়, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও ও গাইবান্ধা; খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, মেহেরপুর ও নড়াইল; সিলেটের চার জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার; বরিশালের ছয় জেলার মধ্যে পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলায় সরকারি আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার নেই।

আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার না থাকায় করোনা শনাক্তের নমুনা সংগ্রহ করে তা বিভাগীয় শহর এবং রাজধানীতে পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে সংক্রমণের বিস্তার দেশের তৃণমূল পর্যায়ে ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. নজরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে জানান, আরটি-পিসিআর পরীক্ষার জন্য নমুনা রংপুর পাঠালে ফলাফল আসতে সাতদিন এবং রাজধানীতে পাঠালে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে।

খুলনা ও রংপুর বিভাগের স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার না থাকা জেলাগুলোতে এ পরীক্ষাগার স্থাপনের কোনো পরিকল্পনা এখন নেই। রংপুরের বিভাগের উপপরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. আবু মো. জাকিরুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, বিভাগের ৫৮টি উপজেলায় জিন এক্সপার্ট মেশিন স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি জিন এক্সপার্ট মেশিনে চারটি নমুনা একবারে পরীক্ষা করা যায়। কিছু মেশিনে আটটি বা ১৬টি নমুনা পরীক্ষা করা যায়। তবে আরটি-পিসিআর মেশিনে ৯৪টি নমুনা একবারে পরীক্ষা করা হয়। দিনে দু-তিন পর্যায়ে (শিফটে) নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ পরীক্ষার জন্য আরটি-পিসিআর মেশিন, বায়োসেপটিক পরীক্ষাগার এবং দক্ষ জনবল প্রয়োজন হয়।

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের পর ব্যাপক পরিসরে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে সব জেলায় আরটি-পিসিআর মেশিন স্থাপনের কথা বলেছিল স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। আরটি-পিসিআর পরীক্ষার পাশাপাশি র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষার কথাও বলা হয়। গেল বছরের শেষে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু করা হয়। তবে আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার স্থাপনের বিষয়টি প্রয়োজনীয় গুরুত্ব পায়নি বলে জানিয়েছেন ভাইরাস ও রোগতত্ত্ববিদরা।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা এবং সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার বাড়ানো উচিত। বাংলাদেশ মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় দেড় বছর হলো। এখনো সব জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার নেই। সব জেলায় এ পরীক্ষাগার না থাকার কারণে নমুনা পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এখনই আরটি-পিসিআর পরীক্ষাগার বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা জিন এক্সপার্ট বাড়ানোর চেষ্টা করছি। যে পদ্ধতিতেই পরীক্ষা করা হোক না কেন লোকবলের সংকট রয়েছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: