দেশের নাগরিকদের প্রাথমিক থেকে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন মেয়াদি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে সরকার। কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ সাফল্যও দেখা গেছে। তবে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি (শীর্ষ) পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের পথে কোথাও কোথাও যথাযথ জনবল চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে। করোনা মহামারীর মধ্যেও বিপর্যস্ত স্বাস্থ্যসেবাকে মজবুত করতে পারেনি স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে অবকাঠামোর উন্নয়ন হলেও তাতে প্রত্যাশিত সেবা পাচ্ছে না জনগণ। এমনকি দেশের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও নানা জটিলতা ও সমন্বয়হীনতায় সেগুলো অব্যবহূতই পড়ে রয়েছে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে ফিজিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক অপারেশনাল প্ল্যানের স্টিয়ারিং কমিটির ১১তম সভায় এসব জটিলতার কথা উঠে আসে। সেখানে বলা হয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণায়ের চতুর্থ স্বাস্থ্য জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচিভুক্ত ফিজিক্যাল ফ্যাসিলিটিজ ডেভেলপমেন্ট (পিএফডি) শীর্ষক কার্য পরিকল্পনা ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য অনুমোদন পায়। এজন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয় ১১ হাজার ৬৭৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এর আওতায় ছিল মূলত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ। একই সঙ্গে তৃতীয় সেক্টর কর্মসূচির আওতায় যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি, তা চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচিতে যুক্ত করা হয়। এ পরিকল্পনার আওতায় বিভিন্ন পর্যায়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক স্বাস্থ্য স্থাপনা নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাবে এখনো সেগুলো চালু করা সম্ভব হয়নি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) সাইদুর রহমান জানান, ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মোট ৭ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে, যা প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ। তবে আরো কিছু কার্যক্রমের দরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। মূল ও প্রথম সংশোধিত কার্য পরিকল্পনায় প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ১১ হাজার ৬৭৬ কোটি ২৬ লাখ টাকা। দ্বিতীয় সংশোধনীতে তা বাড়িয়ে ১৫ হাজার ৭১০ কোটি ৪৩ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হলেও সময়কাল বাড়ানো হয়নি।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানিয়েছে, কার্য-পরিকল্পনার আওতায় সারা দেশে ৪২৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ৩৬৬টির কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচির দ্বিতীয় সংশোধনীতে কয়েকটি মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র এবং হাসপাতালের প্রস্তাব পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর করলেও তা স্টিয়ারিং কমিটি আমলে নেয়নি। কারণ এর আগে যেসব মা ও শিশুকল্যাণ কেন্দ্র বা হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে তাতে জনবল, আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতির অভাবে সেবা দেয়া যাচ্ছে না।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রাজশাহীর বাঘা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কথা। চার বছর আগে এ প্রতিষ্ঠানটিকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও লোকবল বাড়ানো হয়নি। ফলে রোগীর চাপ বেড়ে গেলে বিপাকে পড়ে কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে ৩১ জন চিকিৎসক ও নার্স সেখানে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। লোকবল ও যন্ত্রাংশের চাহিদার কথা জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে চিঠি দেয়া হলেও নতুন নিয়োগ হয়নি বলে জানিয়েছেন উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের এক কর্মকর্তা। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ের চিকিৎসকদের বিভিন্ন পর্যায়ের পদের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশই ফাঁকা। ফলে সেখানে স্বাস্থ্যসেবা নাজুক অবস্থায় রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে ২৩ জন (চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রী) থাকার কথা রয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে সাধারণত ৫০ শতাংশই নার্স। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে প্রতি ১০ হাজার মানুষের বিপরীতে রেজিস্টার্ড চিকিৎসক রয়েছেন ৬ দশমিক ৭৩ জন। সরকারি হাসপাতালে প্রতি ১০ হাজার জনসংখ্যার বিপরীতে শয্যা সংখ্যা ৩ দশমিক ৩০টি। বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল জানিয়েছে, দেশে প্রতি চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন দশমিক ৩০ জন।
স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারের কাঠামো ভালো থাকলেও পরিকল্পনায় ঘাটতি ও দক্ষ লোকবলের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মানবসম্পদে পিছিয়ে রয়েছি। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিতদের যথাযথ প্রশিক্ষণ নেই। স্বল্প লোকবল নিয়ে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে স্বাস্থ্যসেবার স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করা যায় না।
তবে সময় উপযোগী লোকবলের কাঠামোর সুপারিশ করা হয়েছে বলে বণিক বার্তাকে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, দেশে বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের লোকবল কাঠামোর পরিকল্পনা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে আমরা খুব শিগগিরই তা বাস্তবায়ন করতে পারব। তবে চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত সব পর্যায়ের লোকবল নিয়োগ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করে না বলেও জানান তিনি।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও প্রকল্পের লাইন ডিরেক্টর (উন্নয়ন) সাইদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, একটা হাসপাতালের শয্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী অবকাঠামোর পাশাপাশি জনবল ও যন্ত্রপাতি একসঙ্গে বাড়াতে হয়। শুধু ভবন নির্মাণ মানেই শয্যা বাড়ানো হয়ে গেল— এমনটি নয়। সেখানে চিকিৎসক, নার্স, আসবাবপত্র ও যন্ত্রপাতিও লাগবে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে হয়তো এটা সম্ভব হয় না। কারণ জনবল নিয়োগ প্রক্রিয়াটা একটু জটিলতাই কোনো ক্ষেত্রে এটা পিছিয়ে যায়। এ প্রকল্পের আওতায় এখন পর্যন্ত যে কাজগুলো করার কথা বলে উপস্থাপন করা হয়েছে, তা আগামী জুনের মধ্যেই শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে বলে জানান শীর্ষ পর্যায়ের এ কর্মকর্তা।