দুর্যোগপ্রবণ এলাকা: স্বাস্থ্যসেবায় বাড়তি খরচের ৭৫ শতাংশই ওষুধে ব্যয়

হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা নাজমুস সাকিব। তার বাড়ি থেকে নিকটবর্তী সরকারি হাসপাতালে আসা-যাওয়া করতে ৩০০ টাকা ব্যয় হয়। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করতে হয় তাকে। প্রতি মাসে পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবার জন্য তিনি বাড়তি খরচ করেন। আবার এর সিংহভাগই খরচ হয় ওষুধ কিনতে।

শুধু হাতিয়া নয়; চর, উপকূল ও হাওরের মতো দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় চিকিৎসার জন্য বেশি খরচ করতে হয় বাসিন্দাদের। এর মধ্যে ওষুধেই তাদের খরচ সবচেয়ে বেশি। চলতি বছর জুনে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পলোস ওয়ান জার্নালে ‘ইমপোভারিশমেন্ট ইমপ্যাক্ট অব আউট অব পকেট পেমেন্টস ফর হেলথকেয়ার ইন রুলাল বাংলাদেশ: ডু দ্য রিজনস ফেসিং ডিফারেন্ট ক্লাইমেট চেঞ্জ রিস্ক ম্যাটার’ শীর্ষক একটি গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের চর, উপকূল ও হাওর এলাকা বেশির ভাগ সময় দুর্যোগকবলিত হয়ে পড়ে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা, গ্রামীণ অবকাঠামো, গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। একই সঙ্গে এসব এলাকার মানুষের মধ্যে রোগের বিস্তার বেশি থাকায় অসুস্থতার হার বেশি। অসচেতনতার কারণে রোগের শুরু থেকে চিকিৎসা না নেয়ার প্রবণতার কারণে তাদের বাড়তি খরচ হয়।

গবেষণাটি ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, পটুয়াখালী ও গাইবান্ধা জেলার চর, হাওর, উপকূল, লবণাক্ত এবং সীমান্ত এলাকার তথ্য নেয়া হয়। এতে প্রতিটি জেলা থেকে চার হাজার পরিবারের ১৮ হাজার ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলা হয়। বছরব্যাপী চলমান এ গবেষণার মূল গবেষক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক আফরোজা বেগম। উপকাঠামো প্রশ্নপত্রের গবেষণা পদ্ধতিতে দুই দফায় তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

গবেষণাটি বলছে, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় সংক্রামক রোগ, অসংক্রামক রোগ, দীর্ঘমেয়াদি রোগের বিস্তারে ভিন্নতা পাওয়া গেছে। দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় চিকিৎসার জন্য বাড়তি খরচ তুলনামূলক বেশি। এর খরচের সিংহভাগই ওষুধ ক্রয়ে খরচ হয়। দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মধ্যে চর এলাকায় বাড়তি খরচের ৭৬ শতাংশ, হাওরে ৭৫ শতাংশ ও উপকূল এলাকায় ৭২ শতাংশ খরচ ওষুধ কিনতে ব্যয় করছেন নাগরিকরা। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম এমন এলাকায় বাড়তি খরচের ৬৭ শতাংশ ওষুধের জন্য ব্যয় করছেন রোগীরা।

গবেষকরা বলছেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা খুবই কম। প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানে যেসব ওষুধ দেয়া হয়, তার বেশির ভাগই সাধারণ ওষুধ। ভিন্নতা খুবই কম। আর কোনো হাসপাতালই পরিপূর্ণ কোর্সের ওষুধ দেয় না। অনেক এলাকায় আবার সরকারি কোনো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান নেই।

অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ওষুধের খরচ বেড়ে যাওয়া মানে চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া। স্বাস্থ্যসেবার জন্য দিন দিন বাড়তি খরচের আকার বড় হচ্ছে। অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা ও সচেতনতার অভাবের কারণে চিকিৎসার ব্যয় বাড়ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্লোবাল হেলথ এক্সপেনডিচার ডাটাবেজ বলছে, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে স্বাস্থ্যসেবার অর্থায়নের সিংহভাগ মূলত রোগীর পকেট থেকে আসে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার খরচের ৭৪ শতাংশ রোগীর নিজস্ব অর্থায়ন থেকে আসে। বিশ্বে গড় রোগীর বাড়তি খরচ ৩২ শতাংশ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা নিতে রোগীর বাড়তি খরচ সবচেয়ে বেশি। ফলে বড় ধরনের রোগের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে গিয়ে পরিবারের অন্যান্য খরচের ওপর প্রভাব পড়ে। এ খরচ পরিবারকে দরিদ্র করছে। বছরে ১৩ শতাংশ পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে শুধু চিকিৎসা ব্যয় বহন করার ফলে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব এলাকায় চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা রয়েছে সেসব এলাকায় অপচিকিৎসা বেশি হয়। এতে ওষুধের প্রয়োগ বেশি হয়। চিকিৎসা তখন ওষুধনির্ভর হয়ে পড়ে। ফলে ওষুধ গ্রহণ ছাড়া মানুষের অন্য কোনো উপায় থাকে না।

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বণিক বার্তাকে বলেন, দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় স্বাস্থ্য কাঠামো দুর্বল। চিকিৎসক নামমাত্র থাকলেও তারা প্রতিষ্ঠানে থাকেন না। চিকিৎসক যেখানে নেই, সেখানে চিকিৎসা হবে কীভাবে? ফলে ফার্মেসি এবং গ্রাম্য চিকিৎসক ব্যবসার জন্য ওষুধ বেশি বিক্রির সুযোগ নিয়ে থাকেন।

Source: Bonik Barta

Share the Post: