দুর্যোগকালীন খাদ্যে খনিজ উপাদানে ভারসাম্যহীনতা

দুর্যোগকালে মানুষকে যেসব খাদ্য সরবরাহ করা হচ্ছে, তাতে পুষ্টি উপাদান হিসেবে খনিজের উপস্থিতি বেশ নাজুক ও অনেকটাই ভারসাম্যহীন। সরবরাহকৃত খাদ্যে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে জিঙ্কের। এ খাদ্যের মাধ্যমে জিঙ্কের চাহিদা মিটছে মাত্র এক-চতুর্থাংশ। ক্যালসিয়ামের চাহিদার অর্ধেক পূরণ হলেও আয়রনের ক্ষেত্রে তা এক-চতুর্থাংশ।

গত মাসে প্রকাশিত বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের (বিএনএনসি) এক প্রকাশনায় দুর্যোগকালে সহায়তাকৃত খাদ্যের পুষ্টিমানের চিত্র উঠে এসেছে। এতে সরকারের প্রদেয় খাদ্যে খনিজের সাতটি উপাদানের সবক’টিতে উচ্চমাত্রার ঘাটতি ও অসামঞ্জস্যতা দেখা গেছে। খনিজ পরিমাপের জন্য নির্দিষ্ট নিয়মে খাদ্যে এগুলোর উপস্থিতি পরীক্ষা করে দেখেছে এ-সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটি।

দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের বিতরণকৃত খাদ্যে খনিজ উপাদানগুলোর মধ্যে জিঙ্কের প্রত্যাশিত পরিমাণ ১৮০ শতাংশ হলেও পাওয়া যাচ্ছে ৪৬ শতাংশ। ক্যালসিয়াম পাওয়া গেছে ৫ শতাংশ। যদিও খাদ্যে এ উপাদান ন্যূনতম ১০ শতাংশ থাকার কথা। সরবরাহকৃত খাদ্যে ১৫১ শতাংশ কপারের বিপরীতে পাওয়া গেছে ৯৫ শতাংশ। এছাড়া আয়রন ও ম্যাগনেশিয়াম যথাক্রমে ২৫ ও ৮৫ শতাংশ পাওয়া গেছে। যদিও অন্যতম এ দুই খনিজ থাকার কথা যথাক্রমে ৯৯ ও ১১৭ শতাংশ।

সরকারের প্রদেয় প্যাকেজে খনিজের উপাদানগুলোর মধ্যে অধিকাংশের উপস্থিতি কম থাকলেও প্রত্যাশিত মাত্রার চেয়ে বেশি রয়েছে আয়োডিন। খাদ্যে আয়োডিন থাকার কথা ১৪৫ শতাংশ, যার বিপরীতে পাওয়া গেছে ৮৪৭ শতাংশ।

পুষ্টিবিদরা বলছেন, দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ও ভিটামিন থাকা প্রয়োজন। তবে এসব পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি শরীরে সঠিক পরিমাণে মিনারেল বা খনিজ গ্রহণ জরুরি। শরীর গঠন, বৃদ্ধি ও সার্বিক সুস্থতার জন্য এসব খাদ্য উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। খনিজ লবণ দেহের অস্থি, দাঁত, এনজাইম ও হরমোন গঠনের জন্য অপরিহার্য। আবার ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড় গঠনে, রক্ত জমাট বাঁধতে, স্নায়ু ব্যবস্থায় সুষ্ঠু কাজ সম্পাদনে সহায়তা করে। লৌহ রক্তের লোহিত রক্তকণিকা গঠন করে। আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থি ও বিপাকের কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে সহায়তা করে। বেশি হলে সেটি ঝুঁকি তৈরি করে। দেহকোষ ও দেহরসের জন্য সোডিয়াম প্রয়োজন। ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, আয়োডিন, লৌহ, সালফার ইত্যাদি লবণ-জাতীয় দ্রব্য খাদ্যের সঙ্গে দেহে প্রবেশ এবং দেহ গঠনে সাহায্য করে।

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুর্যোগপীড়িত জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেয়া শুরু করে। শুকনো খাবারের প্যাকেজসহ বিভিন্ন খাদ্য সহায়তার পুষ্টিমান উন্নয়নের লক্ষ্যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে তার সুপারিশ করার জন্য স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে দুর্যোগ মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের মার্চে বিএনএনসি মহাপরিচালককে প্রধান করে ১১ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ। কমিটি দুর্যোগপীড়িত জনগোষ্ঠীর পুষ্টি ঝুঁকি হ্রাসে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিভিন্ন বয়স ও নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য চাহিদা নির্ধারণ করতে বলা হয়। একই সঙ্গে প্রদেয় খাদ্য সাহায্য পর্যালোচনা, খাবারের মূল্য, পুষ্টিমান, নিরাপত্তা, সহজলভ্যতা, গ্রহণযোগ্যতা, পরিবহন, বিতরণ, গুদামজাত ও খাদ্য প্রস্তুতকরণ বিবেচনাপূর্বক বিভিন্ন বয়স ও জনগোষ্ঠীর জন্য পুষ্টি সমৃদ্ধ প্যাকেজের বিষয়ে সুপারিশ করতে অনুরোধ করা হয়। সরকারের প্রদেয় খাবার পরীক্ষা করে খাদ্য তালিকায় প্রয়োজনীয় পুষ্টিমানের জন্য গত বছরের মে মাসে সুপারিশ করে কারিগরি কমিটি।

এ বিষয়ে কমিটির সাধারণ খাদ্য প্যাকেজ দলের প্রধান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. নাজমা শাহীন বণিক বার্তাকে জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যে খাদ্য দুর্যোগপীড়িতদের দেয় তা নির্দিষ্ট করে পরিমাপ করা হয়। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে খাদ্যের এ পরিমাপ করা হয়েছে। দুর্যোগের সময় আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করার সময়ের জন্য, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফেরার পর এবং শিশুদের জন্য খাদ্যের প্যাকেজ তৈরি করা হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রদেয় খাদ্যে পুষ্টির ঘাটতি ছিল। আমরা সাতদিনের জন্য প্যাকেজ তৈরি করেছিলাম। এমনভাবে তৈরি করেছিলাম যাতে ওই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূর্ণ হয়। আগের প্যাকেজ শুধু এনার্জি পূরণ করত। আগের প্যাকেজে আয়োডিনযুক্ত লবণ দেয়া হতো, যা পরিবারের চাহিদার চেয়েও বেশি। তবে অন্য পুষ্টি উপাদান প্রয়োজনের তুলনায় কম। কোনোটা আবার ২৫ শতাংশের কম। তবে খাবার তো আর শতভাগ মেপে খাওয়া যায় না। ন্যূনতম হিসাব করা হয়। এমনভাবে হিসাবে রাখা যায়, হাতে কিছুটা বেশি হলে বা কম হলে ক্ষতি না হয়।

জানা গেছে, দুর্গত জনগোষ্ঠীর জন্য খাবার হিসেবে চাল, তেল, মসুর ডাল, চিঁড়া, লবণ, পেঁয়াজ, আলু, হালুয়া, ধনিয়া, জিরা, মাস, কাঁচামরিচ, শুকনা মরিচ, বরবটি, মিষ্টি কুমড়া, লালশাক, চিনি ও নুডলস দেয়ার সুপারিশ করেছে পরামর্শক কমিটি। এতে দৈনিক প্রতিজনের ২ হাজার ১০০ কিলোক্যালরি চাহিদা পূরণ করবে, তেমনি সাধারণ মানুষ এবং গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের শারীরিক চাহিদা পূরণ করে। এতে দুগ্ধদানকারী মায়ের শিশুদের পুষ্টি চাহিদাও নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগ আক্রান্ত মানুষের প্রাথমিক খাবার হিসেবে যে চাল বিতরণ করা হচ্ছে, সেটি পুষ্টিসমৃদ্ধ চাল হলে একই সঙ্গে দুটি উদ্দেশ্য পূরণ করা সম্ভব। চাল যদি অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ হয়, তাহলে মানুষের দৈনিক চাহিদা ও পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। কেননা ধানের বেশকিছু জাত রয়েছে, সেগুলো অধিক জিঙ্ক ও পুষ্টিসমৃদ্ধ। এসব চাল প্রয়োজনে আরো উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণে গবেষণা প্রয়োজন। দেশের মানুষের পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অনেকটাই সহজ হবে।

এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, দুর্যোগকালে প্রথম লক্ষ্য থাকে মানুষকে উদ্ধার করা। দুর্যোগে না খেয়ে মারা গেছে এমন রেকর্ড আমাদের নেই। তবে দুর্যোগ আক্রান্তদের খাবারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদা যাতে পূরণ হয়, সে বিষয়টা নিয়ে খাদ্য তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে চাল ও ডালের সঙ্গে, আলু, তেল, বাচ্চাদের জন্য নুডলস ছাড়াও বেশকিছু খাবারের আইটেম রাখা হয়। প্রতিটি প্যাকেটে প্রায় ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকার খাবার দেয়া হয়। আমাদের দেশে দুর্যোগে আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্তের হার বেশি হলেও অনেক ক্ষেত্রে সীমিত বাজেটের মধ্যে দক্ষতার সঙ্গে বিতরণ করে থাকি। স্বাভাবিক পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য নীতি ও আর্থিক সহায়তা আমরা করে যাচ্ছি। তবে উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার বিতরণের নীতিমালা করা প্রয়োজন। সেটিও আমরা কারিগরি কমিটির সুপারিশে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেব।

পরামর্শক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যে খাদ্য দেয়া হয়, তাতে সঠিক পুষ্টি বা প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে কিনা তা পরামর্শক কমিটি যাচাই করে দেখে। এতে পরামর্শক কমিটি যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষা শেষে খাদ্য তালিকা ও উপাদানের পরিমাণ উল্লেখ করে তালিকা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে দেয়। পরবর্তী সময়ে গত বছরের মে মাসে সরকারের দুর্যোগ মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করেছে। পরামর্শ অনুযায়ী দুর্যোগপীড়িত জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং জাতীয় গাইডলাইন মেনে কমিটি সব বয়সীদের জন্য বিশেষ করে নারী, শিশু ও বয়স্কদের জন্য খাদ্য প্যাকেজ নির্ধারণ করে। এতে গড়ে প্রতিটি পরিবারে পাঁচজন সদস্যকে ধরে প্রথমে তিনদিন ও পরে সাতদিনের জন্য প্যাকেজ তৈরি করা হয়।

দেশের মানুষের সঠিক পুষ্টির নিশ্চিতে সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম চলছে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দেশে ৩০০টির অধিক পুষ্টির প্রকল্প চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছে বিএনএনসি। তবে সঠিক পরিমাপের পুষ্টি ও খাদ্যে প্রয়োজনীয় সব উপাদান পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে এখনো দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপুষ্টি দেখা যাচ্ছে।

বিএনএনসির অপর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, পাঁচ বছরের কম বয়সীদের দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি বা খর্বতা ৩১ শতাংশ, তীব্র অপুষ্টি বা কৃশতা ৮ শতাংশ এবং বয়স অনুপাতে কম ওজন ২২ শতাংশ। শিশু ও নারীদের ক্ষেত্রে সাব-ক্লিনিক্যাল আয়োডিনের (ভিটামিন-এ) স্বল্পতাও রয়েছে। সর্বশেষ হিসাবে শিশুদের ৪০ শতাংশই এ সমস্যায় রয়েছে। আর নারীদের মধ্যে ৪২ শতাংশের মধ্যে এ সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে রক্তস্বল্পতা মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ।

জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বণিক বার্তাকে বলেন, খাদ্যে সঠিক প্রোটিন আছে কিনা বা পুষ্টিগুণ ঠিক আছে কিনা তা আমাদের দেশে দেখা হয় না। একমাত্র হাসপাতাল ও কারাগরে কিছু নির্দিষ্ট পরিমাপ রয়েছে। তবে তাও সঠিকভাবে মানা হয় না। খাদ্যগুণ নিয়ে আগে চিন্তাই করা হতো না। এখন কিছুটা চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। খাদ্যে সব ধরনের প্রয়োজনীয় উপাদান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এটা মানুষের অধিকার। খাবার নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণেও মানার বিষয়টি ছিল না, এটা শুরু হয়েছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: