বাড়ছে সাপে কাটা রোগী: গ্রামে শতভাগ রোগী তবে চিকিৎসা শহরে

সম্প্রতি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার তুলাতলী গ্রামে ১৫ বছরের কিশোর আবু বকরকে চন্দ্রবোড়া সাপে কাটে। কিছুক্ষণের মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনলেও সেখানে ছিল না অ্যান্টিভেনম। পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা হয়। এর দুই রাত দুইদিন পর অবস্থার অবনতি হলে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান চিকিৎসকরা। সেখানে চিকিৎসা না হওয়ায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসকরা দেখেন, বিষক্রিয়ায় এ কিশোরের কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পরে চিকিৎসা দিয়েও বাঁচানো যায়নি। সাপে কাটার ছয়দিনের মাথায় মারা যায় সে।

শুধু আবু বকরই নয়। দেশে প্রতি বছর প্রায় ছয় হাজার সাপে কাটা রোগী মারা যাচ্ছে শুধু সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ায়। আর বছরে ৫ লাখ ৮০ হাজার মানুষ সাপের দংশনের শিকার হয়। এসব রোগীর প্রায় শতভাগ গ্রামের হলেও জরুরি এ চিকিৎসাসেবা শহরকেন্দ্রিক। সাপের বিষের প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম নেই বেশির ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। একই সঙ্গে উপজেলায় নিয়োজিত চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা ও সচেতনতার অভাবে চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগীর প্রায় শতভাগ গ্রামে হওয়ায় চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রাম পর্যায়ে হওয়া দরকার।

মূলত মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশে সাপে কাটা রোগী বেশি পাওয়া যায়। চলতি বছরের এ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে আঘাত, দুর্ঘটনা, অপঘাতের মৃত্যুর তালিকায় সাপে কাটা রোগী এবং মৃত্যুর সংখ্যা যুক্ত করা হয়। ফলে দেশে প্রতি বছর কতজন সাপের দংশনের শিকার হয় তার সঠিক হিসাব জানে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

তবে ২০১৯ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর অন্তত পৌঁনে ছয় লাখ মানুষ সাপের দংশনের শিকার হয়। এতে মারা যায় ছয় হাজারের বেশি। বছরে সারা বিশ্বে ৫৪ লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। এদের মধ্যে ২৭ লাখ নারী, পুরুষ এবং শিশু বিষের প্রভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরি অ্যান্টিভেনম নেই। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে অ্যান্টিভেনম না থাকা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে রোগীরা জেলা হাসপাতালে আসছেন। কোনো কোনো জেলা হাসপাতালেও চিকিৎসা না পাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাপে কাটা রোগীদের ভিড় বাড়ছে।

দেশের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি রোগী রাজশাহী অঞ্চলে দেখা গেলেও সবাই হাসপাতাল পর্যন্ত আসছেন না। তৃণমূলে চিকিৎসার ঘাটতি থাকায় ভুক্তভোগীরা ওঝার কাছে যাচ্ছেন। ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১ হাজার ৬২৬ জন সাপে কাটা রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। এর মধ্যে শঙ্খচূড়, শঙ্খিনী বা ভোতালেজ কেউটে, চন্দ্রবোড়া সাপে কাটা রোগী ৪৩৯ জন। চিকিৎসায় বিলম্ব হওয়ায় হাসপাতালে এসেও মারা গেছেন ১২০ জন। একই ভাবে চট্টগ্রামের উপজেলা পর্যায়ে যথাযথ চিকিৎসা নেই বলে জানান চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও ভেনম সেন্টারের গবেষক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, সম্প্রতি দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২০ ভায়াল অ্যান্টিভেনম পাঠানো হয়েছে। প্রতি ১০ ভায়াল থেকে এক ডোজ প্রস্তুত করা হয়। সেক্ষেত্রে এই ২০ ভায়াল দুজন সাপে কাটা রোগীকে প্রয়োগ করা যাবে। আর জেলা হাসপাতালগুলোকে সরবরাহ করা হয়েছে ৫০ ভায়াল করে অ্যান্টিভেনম। শুধু মেডিকেল কলেজগুলোর চাহিদা অনুযায়ী ৫০০ ভায়াল বা তার কমবেশি অ্যান্টিভেনম দেয়া হয়েছে। দেশে বছরে ঠিক কত রোগী সর্পদংশনের শিকার হন বা মারা যান তার সঠিক হিসাব না থাকায় অ্যান্টিভেনমের চাহিদা বা প্রয়োজনীয়তা নির্ণয় করা যাচ্ছে না। তবে বছরে প্রায় ৪০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনম আমদানি করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাপে কাটা রোগীর প্রায় শতভাগ গ্রামাঞ্চলের। গ্রামই সাপের আবাস্থল। অসাবধানতাবশত চলাফেরা এবং কাজ করার সময় সাপে দংশন করে। মাঠের গর্ত, ধানক্ষেত, পাখির বাসায় আশ্রয় নেয়া সাপের দংশন বেশি হচ্ছে। কৃষক-জেলেরা দংশনের শিকার বেশি হন। বর্ষাকালে জায়গা সংকুচিত হওয়ায় সাপ মানুষের আবাসস্থলে চলে আসে। সাপে কাটা রোগীরা নিকটবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসা পান না। বিষয়টি অবহেলিত। ওষুধ না থাকা এবং প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের অভাবে জরুরি সেবাবঞ্চিত হচ্ছে মানুষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. এমএ ফায়েজ বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা হয় না। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিক্ষার্থীরা এ চিকিৎসা শিখছেন না। এ শিক্ষার্থীরাই যখন চিকিৎসক হয়ে প্রান্তিক পর্যায়ে যান তখন সাপে কাটা রোগীকে যথাযথ চিকিৎসা দিতে পারেন না। একই সঙ্গে এ চিকিৎসা বেশ জটিল। অ্যান্টিভেনমের প্রয়োগও অনেক জটিল। সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসায় অক্সিজেনসহ অনেক সময় বিভিন্ন উপকরণ প্রয়োজন হয়। তবে উপজেলা হাসপাতালে এগুলো নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, চিকিৎসককে প্রশিক্ষিত করতে শিগগিরই মডিউলের কাজ শুরু হবে। অ্যান্টিভেনমের যেন ঘাটতি না থাকে এর জন্যও কাজ চলছে। মূলত অসচেতনতার কারণে সাপে কাটা রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: