বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গৃহীত কৌশল অনুযায়ী, বিশ্বের প্রতিটি দেশে ডিসেম্বরের মধ্যে মোট জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশের কভিড-১৯-এর টিকাদান সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। একই সময়সীমায় দেশের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ৫০ শতাংশের দুই ডোজ টিকাদান সম্পন্ন করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল বাংলাদেশ সরকারও। তবে বর্তমানে যে গতিতে টিকাদান কর্মসূচি এগোচ্ছে, তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, টিকা কর্মসূচির বর্তমান গতিতে ডিসেম্বরের মধ্যে সরকার বা ডব্লিউএইচওর লক্ষ্য অর্জন না হওয়ার বড় ধরনের শঙ্কা রয়েছে।
দেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণপরিসরে করোনার টিকা প্রয়োগ শুরু হয়। এ পর্যন্ত দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না ও সিনোফার্মের টিকার প্রয়োগ চলছে। এ চার টিকা ছাড়াও জনসন অ্যান্ড জনসন, সিনোভ্যাক্স, স্পুতনিক-৫ এবং সুইডেন অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভ্যাক্সজেভ্রিয়া টিকা দেশে জরুরি প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
করোনার টিকা প্রয়োগে সরকারের জাতীয় পরিকল্পনা (ন্যাশনাল ডেপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ভ্যাকসিনেশন প্ল্যান ফর কভিড-১৯ ভ্যাকসিন ইন বাংলাদেশ) অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনবে সরকার। তিন পর্যায়ে মোট পাঁচ ধাপে এসব জনগোষ্ঠীকে টিকা দেয়া হচ্ছে। লক্ষ্য অনুযায়ী, মোট ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জনকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনা হবে। দুই দফা টিকাদানে তাদের জন্য ভ্যাকসিনের প্রয়োজন পড়বে মোট ২৭ কোটি ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ডোজ। লক্ষ্য অনুযায়ী, নির্ধারিত এ জনগোষ্ঠীর অর্ধেককে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে দুই ডোজ টিকা দেয়ার কথা। অর্থাৎ ডিসেম্বরের মধ্যেই ৬ কোটি ৯১ লাখ ২৩ হাজার মানুষকে দুই ডোজ করে ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ডোজ টিকা প্রয়োগের লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশে গণপরিসরে টিকা প্রয়োগ শুরু হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এর পর থেকে গতকাল পর্যন্ত নয় মাসে প্রথম ও দুই ডোজ মিলিয়ে ৭ কোটি ৩৩ লাখ ১০ হাজার ডোজ টিকা প্রয়োগ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ৩ কোটি ২ লাখ ৮ হাজার ৭০০ জনের টিকাদান পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২২ শতাংশ এবং দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ শতাংশ। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর ৫০ শতাংশের টিকাদান সম্পন্নের মাইলফলক অর্জন করতে হলে আরো ৬ কোটি ৪৯ লাখ ৩৮ হাজার ডোজ টিকা প্রয়োগ করতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ছয় লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হচ্ছে। অন্যান্য সরকারি ছুটি না থাকলে শুক্রবার বাদে প্রতি মাসে গড়ে ২৬ কার্যদিবস টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত দুই মাসে ৪৯ কার্যদিবসে দৈনিক গড়ে ছয় লাখ টিকা প্রয়োগ করলেও তাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি ডোজ টিকা প্রয়োগ করা যাবে। এর পরও বাকি থাকবে সাড়ে তিন কোটির কাছাকাছিসংখ্যক ডোজ। এখনকার গতি অনুযায়ী এ টিকা প্রয়োগ সম্পন্ন করতে ডিসেম্বরের পর আরো আড়াই মাস সময় লাগবে। অর্থাৎ বর্তমান গতি বজায় থাকলে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে পাঁচ কোটি মানুষেরও পূর্ণাঙ্গ টিকাদান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। সেক্ষেত্রে এ সময়ের মধ্যে ডব্লিউএইচওর কৌশল অনুযায়ী জনসংখ্যার ৪০ শতাংশকেও কভিডের পূর্ণাঙ্গ টিকা দেয়ার লক্ষ্য পূরণ নিয়ে বড় আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে।
এদিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্দিষ্টসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে করোনার টিকার আওতায় আনতে গৃহীত পরিকল্পনার বাইরেও বিশেষ কিছু কর্মসূচি হাতে নিয়েছে সরকার। মূলত দ্রুততম সময়ের মধ্যে বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকা দিতে এসব কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। তবে এসব কর্মসূচিতেও লক্ষ্য অনুযায়ী গতি পাচ্ছে না কভিডের সার্বিক টিকাদান কার্যক্রম। বরং বর্তমান গতিতে লক্ষ্যের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর বাইরে ১২-১৭ বছর বয়সী মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনার ফলে কিছুটা গতিশীল হলেও টিকাদান কার্যক্রমের বর্তমান গতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নয় মাস ধরে দেশে গণপরিসরে করোনার টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম চলছে। টিকা প্রয়োগের বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে ডিসেম্বরের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে চার মাসের বেশি সময় লাগবে। অথচ সময় রয়েছে দুই মাসের কম। তবে দৈনিক টিকাদানের সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি অন্তত তিনটি বিশেষ কর্মসূচি (টিকা ক্যাম্পেইন) চালানো হলে শঙ্কা কমে আসবে।
ডব্লিউএইচওর বৈশ্বিক করোনার টিকা প্রদান কৌশল অনুযায়ী, গত সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিটি দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার কথা। এছাড়া চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং আগামী জুনের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার জন্য প্রতিটি দেশকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। বিশ্বের ৫৬টি দেশ সেপ্টেম্বরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। এক্ষেত্রে লক্ষ্যের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। এতে কোনো ব্যক্তি করোনায় সংক্রমিত হলেও তার জীবন সংকটাপন্ন হবে না। একই সঙ্গে শুরুতে যাদের টিকা দেয়া হয়েছে তাদের আবারো বুস্টার ডোজ বা নতুন করে দুই ডোজ টিকা দেয়া উচিত। তাদের দেয়া টিকার কার্যকারিতা দিন দিন কমে আসছে। তবে সবাইকে টিকা না দিয়ে তাদের টিকা দেয়া যাবে না।
বাংলাদেশ ফার্মাকোলজি সোসাইটির সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, নিয়মিত টিকা কার্যক্রম চলাকালে এ পর্যন্ত দুটি টিকা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা হয়েছিল। এতে স্বল্প সময়ে ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়া হয়েছে। টিকা প্রয়োগের বেশির ভাগই এ ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আরো কয়েকটি টিকা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করতে পারলে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা যাবে। তবে তাতে ইপিআইয়ের নিয়মিত কার্যক্রম চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে। একই সঙ্গে টিকা প্রয়োগে যত দেরি হবে, আগে নেয়া ব্যক্তিদের শরীরে তার কার্যকারিতা কমে যাবে।
টিকা প্রয়োগের বর্তমান গতি ও সরবরাহের কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্দিষ্ট টিকার ডোজ প্রয়োগ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। যদিও সরকার দৈনিক টিকা প্রয়োগের সক্ষমতা বাড়িয়ে তা ১০ লাখে আনার কথা বলছে। তবে তাতে সম্প্রসারিত টিকা কর্মসূচির (ইপিআই) নিয়মিত টিকা প্রয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে।
ইপিআইয়ের সাবেক প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. তাজুল ইসলাম এ বারি বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার প্রাদুর্ভাব কাটিয়ে উঠতে বৈশ্বিক ও প্রতিটি দেশের অভ্যন্তরীণ লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। টিকার ক্ষেত্রেও তাই। তবে যত দ্রুত সম্ভব ৭০ শতাংশকে টিকার আওতায় আনতে হবে। কম সময়ে বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। টিকা পাওয়া সাপেক্ষে ক্যাম্পেইন পরিচালনা করলে ডিসেম্বর পর্যন্ত নেয়া লক্ষ্যমাত্রার কিছুটা বস্তবায়ন হবে।
তবে এখনো টিকা প্রয়োগের সংখ্যা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে বলে দাবি করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, টিকা মজুদ থাকা সাপেক্ষে আমরা আগের দুটি টিকা ক্যাম্পেইনের মতো ক্যাম্পেইন চালু করব। দৈনিক প্রয়োগের সক্ষমতা বাড়ানো হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছা অসম্ভব কিছু নয়।