এক যুগেরও বেশি সময় আগে মাটি কাটার কাজ করতে গিয়ে ডান হাত ভেঙে যায় পিরোজপুরের দিনমজুর ফারুখ মোল্লার। অভ্যাসবশতই স্থানীয় গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নেন তিনি। কিন্তু হাতের অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন তিনি। কিন্তু সে সময় আর কিছু করার ছিল না চিকিৎসকের। ফলে হাতটি কিছুটা বেঁকে যায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেয়া গেলে এমনটি হতো না। একই এলাকার কুলসুম আক্তার এখন অন্য কারো সাহায্য ছাড়া চলাফেরা করতে পারেন না। ১৫ বছর বয়স থেকে তার শারীরিক অক্ষমতা প্রকাশ পেতে শুরু করে। কিন্তু সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে না পারায় তিনিও সুস্থ হতে পারেননি। সরকারের পরিসংখ্যান বলছে, ভুল চিকিৎসা ও অজ্ঞাত অসুখের সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার কারণে বছরে অন্তত ২৬ শতাংশ মানুষ শারীরিকভাবে অক্ষম হচ্ছে।
সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার কারণে অসুস্থ মানুষদের একটি বড় অংশ দীর্ঘমেয়াদে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোগত বিস্তৃতি বাড়লেও এর সঙ্গে সাধারণ মানুষকে ততটা যুক্ত করা যায়নি। ফলে রোগে আক্রান্তদের বড় একটি অংশ সেবা ও স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২০-তে বলা হয়েছে, দেশে প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে নয়জন কোনো না কোনো কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম। তাদের মধ্যে ৩ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ সঠিক চিকিৎসার অভাবে বা ভুল চিকিৎসার কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছে। এছাড়া অজ্ঞাত অসুখের কারণে অক্ষম হচ্ছে ২৩ শতাংশ মানুষ। জরিপে দেখা গেছে, তাদের মধ্যে ৫২ শতাংশ জন্মগত কারণে, ৯ শতাংশ দুর্ঘটনায়, ১১ শতাংশ মানুষ বার্ধক্যজনিত কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়। অক্ষমতার মাত্রার দিক দিয়ে তাদের তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যার মধ্যে পুরোপুরি অক্ষম ২৯ শতাংশ। এছাড়া ৪৩ শতাংশের অক্ষমতা জটিল পর্যায়ে রয়েছে এবং ২৮ শতাংশের অক্ষমতার মাত্রাকে বলা হচ্ছে মৃদু।
জরিপে অংশ নেয়া পরিবারগুলোতে যেসব অক্ষমতা দেখতে পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে রয়েছে চশমা চোখে দিয়েও যথাযথভাবে দেখতে না পাওয়া, যন্ত্রের সহায়তা নিয়েও শুনতে সমস্যা হওয়া, অসুস্থতার কারণে কোনো কিছু মনে রাখতে না পারা, কারো সাহায্য ছাড়া খাবার গ্রহণ, গোসল, শৌচকাজ বা পোশাক পরিবর্তনের মতো সাধারণ কাজগুলো করতে না পারা, আরেকজন মানুষের বক্তব্য বুঝতে না পারা ও অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষমতা না থাকা বা অটিজমের মতো সমস্যা। এসব সমস্যার কোনোটি হয়তো জন্মের সময় থেকেই শুরু হয়েছে। আবার কোনোটি তার জীবনের যেকোনো পর্যায়ে এসে দেখা দিয়েছে।
ভুল চিকিৎসায় ৩ দশমিক ২ শতাংশের শারীরিকভাবে অক্ষম হওয়ার যে বিষয়টি জরিপে উঠে এসেছে সেখানে ‘ভুল চিকিৎসা’ শব্দটি নিয়ে আপত্তি তুলেছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, চিকিৎসা যে ভুল দেয়া হয়েছে, সেটি এক কথায় বলে দেয়া যায় না। হতে পারে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পাওয়ার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া পক্ষাঘাত, বাতরোগ, আগুনে পোড়া, সড়ক দুর্ঘটনা, বার্ধক্যসহ নানা কারণে শারীরিক অক্ষমতার সৃষ্টি হয়। সঠিকভাবে সঠিক সময়ে এসব রোগের চিকিৎসা শুরু করা না গেলে এসব সমস্যা আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। শতকরা ৬০ শতাংশ মানুষ এখনো অনানুষ্ঠানিক চিকিৎসা পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে।
ওষুধের দোকান বা হাতুড়ে চিকিৎসকের মাধ্যমে চিকিৎসার ফলাফল কখনই ভালো হয় না বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি বলেন, মূলত সঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চিকিৎসা না নেয়ার ফলে সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বাইরে দেশের মানুষের বড় একটি অংশ ফার্মেসি ও হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে যায়। এতে তারা সঠিক রোগ নিরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ থেকে বঞ্চিত হয়। আমরা এমন অনেক রোগী পাই, যারা অসুস্থতার শুরুতে সঠিক চিকিৎসকের কাছে যাননি। যখন চিকিৎসকের কাছে আসেন, তখন আর কিছু করার থাকে না।
যারা এসব অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় চিকিৎসা নিয়ে থাকেন, তাদের চিকিৎসার মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিতে বলেন এ চিকিৎসক। তিনি বলেন, সরকার স্বাস্থ্যসেবার জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা অনেক বাড়িয়েছে। সমস্যা হলো এর সঙ্গে সেবাপ্রত্যাশীদের তেমন একটা যুক্ত করা যায়নি। সেজন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রয়োজনীয় রোগ নিরীক্ষণ সুবিধা বাড়াতে হবে। এখনো ৮০ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা সরকারি প্রতিষ্ঠানে নেই। একইভাবে চিকিৎসক ও নার্সসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিতে সেবার মানসিকতা আনতে হবে। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে মানুষ অবহেলা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের কারণে যেতে চায় না। তার চেয়ে বাড়ির পাশের ফার্মেসির মালিক বা গ্রাম্য চিকিৎসককে আপন মনে করে তাদের কাছে চিকিৎসার জন্য যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এ সমস্যাটিরও সমাধান করতে হবে।
কেবল এ চিকিৎসকরাই নন, বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক চিকিৎসার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কথা। সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্য বলছে, সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ওষুধের দোকান, হাতুড়ে চিকিৎসক ও নিজে নিজে চিকিৎসা গ্রহণ করে দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ। এছাড়া মাত্র ৩ শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতাল থেকে ওষুধ পেয়ে থাকে। আর রোগ নিরীক্ষণের ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে সেবাপ্রত্যাশীরা মাত্র ১৫ শতাংশ পরীক্ষার সুবিধা পায়। ফলে মূল অংশটিকেই বাকি পরীক্ষার জন্য বেসরকারি পরীক্ষাগারের ওপর নির্ভর করতে হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ভুল চিকিৎসা মূলত অযোগ্য বা হাতুড়ে চিকিৎসকের কারণে হয়ে থাকে। অনেক সময় চিকিৎসার প্রটোকল না মানার কারণেও জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। ফলে পরে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এছাড়া বাংলাদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে রেফারেল ব্যবস্থা তেমন প্রচলিত নয়। তবে রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনা করা গেলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলেও মত দেন তিনি।
অজ্ঞাত অসুস্থতা বা অসুখ চিহ্নিত করতে না পারার কারণে অনেক সময় শারীরিক অক্ষমতার সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করেন অর্থোপেডিক সার্জন অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক অসুস্থতা রয়েছে, যা অজানা কারণে হয়ে থাকে। তবে মানুষের সচেতনতার অভাবে সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা দেয়া যায় না। অসুস্থ হলে নিজে নিজে ওষুধ গ্রহণ বা ঝাড়ফুঁক ও হাতুড়ে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া রোগ মুক্তির বড় অন্তরায়। আবার এটাও ঠিক, কেবল একটি জরিপের তথ্য দিয়ে এ বিষয়টি প্রমাণ করা সম্ভব নয়। এজন্য বিশদ বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রয়োজন। অপচিকিৎসা থেকে বাঁচতে দেশে সচেতনতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলেও মনে করেন স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এ চিকিৎসক।