বাংলাদেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে আতঙ্কে দিন কাটিয়েছেন অন্তঃসত্ত্বা ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। কারণ একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত জানা যায়নি, অন্তঃসত্ত্বা ও তার গর্ভের সন্তানের ওপর কভিড-১৯ রোগের প্রভাব। আবার বিশ্বজুড়ে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হলেও শুরুতে গর্ভবতীদের টিকা দেয়া নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। কোনো কোনো দেশ টিকা দিতে শুরু করলেও বাংলাদেশের মতো অনেক দেশ এ সিদ্ধান্ত নিতে সময় নিয়েছে। পাশাপাশি গর্ভবতী নারীদের ওপর রোগটির প্রভাব নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। সম্প্রতি তেমনই এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা পজিটিভ নারীদের ৭৮ শতাংশই নির্ধারিত সময়ের আগে সন্তান জন্ম দিয়েছেন। এছাড়া তাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে নানা ধরনের জটিলতারও।
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) অ্যাসোসিয়েশন অব কভিড-১৯ উইথ ম্যাটার্নাল অ্যান্ড প্যারিন্যাটাল আউটকামস ইন প্রেগন্যান্সিস ডিউরিং প্যানডেমিক ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণায় এসব জটিলতার কথা উঠে এসেছে। গতকাল এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এ কাজে গত বছরের এপ্রিল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত রাজধানীর তিনটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং একটি সরকারি বিশেষায়িত মা ও শিশু হাসপাতালের প্রায় ৯০০ প্রসূতির তথ্য সন্নিবেশ করা হয়েছে, যার মধ্যে ২১৫ জন প্রসূতি করোনা পজিটিভ ছিলেন।
গবেষণায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশিকা মেনে গর্ভকালীন প্রসূতিদের জটিলতা এবং সন্তান জন্মের আগে ও পরে সাতদিনের মধ্যে নবজাতকের নানা জটিলতার তথ্য নেয়া হয়েছে। তথ্যদাতা প্রসূতিদের গড় বয়স ছিল ২৬ বছর। তবে এর মধ্যে ৫৪ শতাংশের বয়স ছিল ২৪ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।
ফলাফলে দেখা গেছে, করোনায় আক্রান্ত প্রসূতিদের মাতৃত্বকালীন জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত গর্ভাবস্থায় প্রসূতিরা যেসব জটিলতায় পড়েন, তা অন্যান্য সময়ের চেয়ে বেড়েছে। করোনা পজিটিভ প্রসূতি মায়েদের মধ্যে ৪৬ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রসবকালীন জটিলতা দেখা গেছে। এর মধ্যে ৭৮ শতাংশ ক্ষেত্রে সন্তান প্রসব হয়েছে নির্ধারিত সময়ের আগে। সাধারণত মায়ের গর্ভে সন্তান ৪০ সপ্তাহ পার করে। কিন্তু কভিড-১৯ পজিটিভ ১০০ প্রসূতির মধ্যে ৭৮ জনের ক্ষেত্রে সন্তান ৩৭ সপ্তাহের আগেই ভূমিষ্ঠ হয়েছে। যেখানে করোনায় আক্রান্ত নন এমন ২৮ শতাংশ প্রসূতির এমন ঘটনা ঘটে।
একইভাবে সন্তান প্রসূতির জরায়ুতে বেড়ে না উঠে তার বাইরে বেড়ে উঠেছে চারজনের ক্ষেত্রে। মাতৃগর্ভে সন্তান মারা যাওয়ার ঘটনাও করোনায় আক্রান্ত প্রসূতির ক্ষেত্রে বেশি দেখা গেছে। শতকরা ১৫ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। যেখানে করোনায় আক্রান্ত নন এমন প্রসূতির ক্ষেত্রে গবেষণায় ব্যবহূত নমুনায় এ ঘটনা একজনের ক্ষেত্রে ঘটেনি। করোনা পজিটিভ প্রসূতিদের মধ্যে সন্তান জন্ম দেয়ার সময় শতকরা একজনের মৃত্যু হয়েছে। একইভাবে গর্ভপাতের ক্ষেত্রেও জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে ১ শতাংশ করোনা পজিটিভ প্রসূতির।
নির্ধারিত সময়ের আগে সন্তান জন্ম নেয়ার ফলে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রসূতি বিশেষজ্ঞরা। প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবসট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বণিক বার্তাকে বলেন, করোনার কারণে প্রসূতি মায়ের শরীরে বিভিন্ন সংক্রমণ দেখা দিতে পারে। মূলত কভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর মায়ের শরীরে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ কারণেই নির্ধারিত সময়ের আগে সন্তানের জন্ম হয়। সাধারণত ২৮ থেকে শুরু করে ৩৭ সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে জন্ম নিলে তাকে প্রিটার্ম ডেলিভারি বলা হয়। এতে সন্তানের শরীরে নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি হয়।
এ বিশেষজ্ঞ জানান, নির্ধারিত সময়ের আগে সন্তান জন্ম নিলে তার ওজন কম থাকে। সে শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণে ভুগতে পারে। এতে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়, অক্সিজেন দেয়া লাগে। একইভাবে নবজাতকের শরীরের তাপমাত্রা কমে যায়। নির্ধারিত সময়ের আগে জন্ম নেয়া শিশু মায়ের বুকের দুধ টেনে পান করতে পারে না। তার শক্তিও কম থাকে। ফলে পরবর্তী সময়ে শিশুটি অপুষ্টির মধ্যে বড় হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণও তাকে দ্রুত কাবু করে ফেলতে পারে।
নিপসমের গবেষণাটি বলছে, কভিড-১৯ আক্রান্ত গর্ভবতীদের প্রায় অর্ধেকেরই মাতৃত্বজনিত জটিলতা দেখা গেছে। ফলে এসব নারীর ৮৩ শতাংশেরই অস্ত্রোপচার বা সি-সেকশনের মাধ্যমে সন্তান জন্ম দিতে হয়েছে। যেখানে নন-কভিড গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে এ হার ৬৮ শতাংশ। গবেষণা বলছে, করোনায় আক্রান্ত নন এমন প্রসূতিদের চেয়ে আক্রান্তদের জটিলতা দেড় গুণ বেড়ে গেছে।
কভিড পজিটিভ গর্ভবতীদের মধ্যে ৯১ শতাংশের মধ্যে করোনা-সংক্রান্ত জটিলতার লক্ষণ দেখা গেছে। প্রকাশ পাওয়া লক্ষণের মধ্যে ৭৮ শতাংশের জ্বর, ৪৪ শতাংশের কাশি, ৪০ শতাংশের শ্বাসকষ্ট, ৩৩ শতাংশের নাকে গন্ধের অনুভূতি হ্রাস, ৩৭ শতাংশের ক্ষেত্রে স্বাদ নষ্ট হয়ে যাওয়া ও ২৭ শতাংশের মাথাব্যথা। কেবল ৮ শতাংশ আক্রান্ত প্রসূতির মধ্যে এসব কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি।
এসব জটিলতার কারণে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের এ সময়ে গর্ভধারণের পরিকল্পনা না করতে নারীদের পরামর্শ দিচ্ছেন প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাকালে গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকা উচিত। নিতান্ত জরুরি না হলে কেউ যেন গর্ভধারণ না করেন। কারণ এ সময় যেসব জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে তা মা ও সন্তানের জীবনের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। প্রসূতি কভিড-১৯ পজিটিভ হওয়ার পর সেটি সন্তানের শরীরে সংক্রমণ না ঘটালেও অনেক জটিলতা সৃষ্টি করছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। একইভাবে যেসব প্রসূতির দীর্ঘমেয়াদি রোগ রয়েছে, তারা করোনায় আক্রান্ত হলে জটিলতা বহু গুণ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে তার জীবন নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রসূতি ও দুগ্ধদানকারী মায়েদের কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী বলেন, খুব প্রয়োজন না হলে এখন গর্ভধারণ থেকে বিরত থাকতে হবে। তবে যারা গর্ভধারণ করেছেন তাদের নভেল করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা গ্রহণ করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত হলেও টিকা অনেক জটিলতা কমিয়ে আনে। একই সঙ্গে দুগ্ধদানকারী মায়েরা টিকা গ্রহণ করবেন। টিকা গ্রহণ করে যদি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা যায়, তাহলে মাতৃত্বকালীন বা প্রসবকালীন জটিলতা অনেকটা এড়ানো যাবে বলে মনে করেন দেশের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ পেশাজীবী চিকিৎসকদের সংগঠনটির সাবেক এ নেতা।
গতকাল দুপুরে নিপসম মিলনায়তনে গবেষণা প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ। এ আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. লোকমান হোসেন মিয়া, বিশেষ অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির, ওজিএসবির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রওশন আরা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (পরিকল্পনা, পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা) ডা. মুনশী মো. ছাদুল্লাহ।