সাতক্ষীরা সদর উপজেলার পঁচিশোর্ধ্ব প্রসূতি মারিয়াম গর্ভধারণের ৩০ সপ্তাহ পর জটিলতা অনুভব করেন। পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মৃত সন্তান প্রসব করেন তিনি। একইভাবে গর্ভধারণের ২৮ সপ্তাহের মাথায় মৃত সন্তান প্রসব করেন সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার কোহিনূর। গর্ভে শিশুর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলে অস্ত্রোপচার করতে হয় তার। অভ্যন্তরীণ আঘাতের ফলে তাদের সন্তানের মৃত প্রসব হয়েছে বলে ধারণা করেছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, নিয়মিতভাবে প্রসবপূর্ব সেবার জন্য চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ না থাকার কারণে এমনটি হয়েছে।
শুধু কোহিনূর ও মারিয়ামই নন। দেশে বছরে পৌনে এক লাখ শিশু প্রসবের সময় মারা যায়। তবে প্রতিরোধযোগ্য এসব মৃত্যু নজরের বাইরেই থেকে যাচ্ছে। দেশে মৃত সন্তান প্রসবের হার কমিয়ে আনতে গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। তবে অন্যান্য বিভাগে এ অগ্রগতি দৃশ্যমান হলেও সিলেট বিভাগ তুলনামূলকভ পিছিয়ে রয়েছে। অ্যান্টিন্যাটাল কেয়ার বা প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার হার বিভাগটিতে কম। পাশাপাশি কিশোরীদের গর্ভধারণ ও অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসবসহ বেশ কয়েকটি কারণে সিলেটে মৃত সন্তান প্রসবের হার বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, ২৮ সপ্তাহের মধ্যে জন্ম নেয়ার পর যে শিশু শ্বাস-প্রশ্বাস নেয় না তাকে মৃত জন্ম নেয়া বা মৃত সন্তান প্রসব (স্টিলবার্থ) বলা হয়। সারা বিশ্বে বছরে প্রায় ২৬ লাখ মৃত শিশুর জন্ম হয়, যার ৯৮ শতাংশই স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে।
সম্প্রতি ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়, বিশ্বে প্রতি হাজারে ১৪টি শিশু জন্মের সময় মারা যাচ্ছে। গত দুই দশকে অঞ্চলভিত্তিক মৃত প্রসবের হারে পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় মৃত প্রসবের হার তৃতীয় সর্বোচ্চ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যমতে, ২০২০ সালে দেশে প্রতি হাজারে ১১টি মৃত শিশু জন্মগ্রহণ করেছে। এ সংখ্যাটি আগের বছরের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি। মৃত সন্তান প্রসবের হারে দেশের আটটি বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে সিলেট বিভাগ। বিভাগটিতে প্রতি হাজারে ১৩টি শিশু জন্মের আগেই মারা যাচ্ছে বা মৃত অবস্থায় জন্ম নিচ্ছে। শুধু গত বছরেই নয়, বিবিএস প্রকাশিত আগের দুটি জরিপেও এমন চিত্র দেখা গেছে। ২০১৮ সালে প্রতি হাজারে ১৪ এবং ২০১৭ সালে ১৯টি শিশু মৃত জন্ম নিয়েছে এ বিভাগে।
গর্ভধারণ থেকে শুরু করে প্রসব পর্যন্ত আটবার প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার পরামর্শ রয়েছে ডব্লিউএইচওর। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ইউটিলাইজেশন অব অ্যান্টিন্যাটাল কেয়ার সার্ভিস ইন বাংলাদেশ: আ ক্রস সেকশনাল স্টাডি এক্সপ্লোরিং দি অ্যাসোসিয়েটেড ফ্যাক্টস’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চারবার প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে সিলেটের প্রসূতিরা সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছেন। এ অঞ্চলের ১০ শতাংশ গর্ভবতী চারবার বা তার কম প্রসবপূর্ব সেবা নিয়েছেন। একই সঙ্গে ৩৯ শতাংশ প্রসূতি এ ধরনের সেবার আওতায় একবারও আসেননি।
মৃত সন্তান প্রসবের সঠিক কারণ সাধারণত নথিভুক্ত করা হয় না বলে জানিয়েছেন খুলনার কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুদীপ বালা। তিনি জানান, বিভিন্ন কারণে মৃত সন্তানের জন্ম হতে পারে। শুধু প্রসবপূর্ব সেবা এবং কিশোরীদের গর্ভধারণ বা অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসবই নয়, যোগাযোগ অবকাঠামোর ভঙ্গুর দশাও এর জন্য দায়ী। হাসপাতাল সেবা বাড়ানো হলেও অনেক অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। নৌকা, রিকশা, ঠেলাগাড়ি বা অটো করে প্রসূতিদের প্রসবের জন্য হাসপাতালে আনার পথেই প্রসব হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে সন্তানের মৃত জন্ম হয়। মৃত সন্তান জন্মের তথ্য নথিভুক্ত করা হলেও কারণগুলো লেখা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক হিসাবও থাকে না। হাসপাতালের বাইরে মৃত সন্তান জন্ম নিলে তার হিসাব থাকে না।
মৃত সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে সিলেটের পরই অবস্থান রংপুরের। বিভাগটিতে ১২ দশমিক ৭টি শিশু মৃত প্রসব হচ্ছে। তবে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বরিশাল বিভাগ। দক্ষিণাঞ্চলের বিভাগটিতে হাজারে ৯টি শিশু মৃত জন্ম নেয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চট্টগ্রামে ১০ দশমিক ৬ জন, ঢাকায় ৯ দশমিক ৬, খুলনায় ১০ দশমিক ২, ময়মনসিংহে ৯ দশমিক ৬ এবং রাজশাহীতে প্রতি হাজারে ১২ দশমিক ৫টি শিশু মৃত্যু জন্ম নেয়।
মা ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য সরকারিভাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কাজ করছে। অধিদপ্তর দুটির কর্মকর্তারা বলছেন, মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যসেবায় দেশের অন্যান্য বিভাগের চেয়ে পিছিয়ে সিলেট, চট্টগ্রাম ও ময়মনসিংহ বিভাগ। এর মধ্যে সবচেয়ে অনগ্রসর বিভাগ হলো সিলেট। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু স্বাস্থ্য) ডা. মোহাম্মদ শরীফ বণিক বার্তাকে বলেন, সিলেটের মানুষেরা প্রসূতিদের ঘরের বাইরে আনতে চান না। সামাজিকভাবে তারা প্রসূতিদের জন্য প্রয়োজনীয় সেবা নেয়ার বিষয়ে অনাগ্রহী।
দেশে মোট মৃত শিশু জন্ম নেয়ার প্রায় ৬৪ শতাংশ মারা যায় প্রসব প্রক্রিয়া শুরুর পর। বাকিদের মৃত্যু হয় ২৮ সপ্তাহ থেকে প্রসব প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়ে।
বিবিএসের তথ্য বলছে, দেশে বয়সভিত্তিক প্রজনন সক্ষমতার হার (টিএমএফআর) ৩ দশমিক ৫৭। যার মধ্যে সিলেট বিভাগে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের প্রজনন সক্ষমতার হার ৪ দশমিক ৪৫। এ বিভাগের ৫০ শতাংশ প্রসূতি নিজ বাড়িতে অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে সন্তান প্রসব করেন। সিলেট ১৫ শতাংশ প্রসূতি প্রসব সেবা নিচ্ছেন।
গাইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃত সন্তান প্রসবের হার শিশু মৃত্যুর হারকে বাড়িয়ে তুলছে। মৃত সন্তান প্রসবের হার উদ্বেগজনক হলেও তা নজরের বাইরে থেকে যাচ্ছে। প্রসবপূর্ব সেবা না নেয়া, কিশোরীদের গর্ভধারণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসব, গর্ভাবস্থায় প্রসূতি কোনো সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, হূদরোগ-জাতীয় অসুস্থতা, অপুষ্টি, ঝুঁকিপূর্ণ জীবনাচরণ, প্রসব প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে মৃত শিশুর জন্ম হতে পারে।
প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা বেগম বণিক বার্তাকে বলেন, বছরে ২৪ থেকে ২৬ লাখ প্রসূতি সন্তান জন্ম দিচ্ছেন। তাদের মধ্যে অনেকেরই গর্ভকালীন ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে সচেনতার অভাব রয়েছে। বহু কারণে মৃত সন্তানের জন্ম হতে পারে। তবে প্রসবপূর্ব সেবা না নেয়া, অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসব এবং কিশোরীদের গর্ভধারণ অন্যতম।
তবে একটি বা দুটি জরিপের আলোকে বিভাগে মৃত শিশু প্রসবের হার বেশি বলা যায় না বলে দাবি করেন সিলেটের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হিমাংশু লাল রায়। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার কমানোর ক্ষেত্রে সিলেট আগের চেয়ে অনেক উন্নতি করেছে। মৃতপ্রসবের কারণগুলো এখন কম। বিভাগের ৩৭টি সক্রিয় উপজেলার মধ্যে ১৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রসবপূর্ব সেবা নেয়ার জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা ক্রমান্বয়ে অন্যান্য সেবা বাড়াচ্ছি।
প্রসবপূর্ব সেবা নিশ্চিত করলেও বাড়িতে অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের কারণে মৃত সন্তান জন্ম নিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন সিলেটের সিভিল সার্জন ডা. প্রেমানন্দ মণ্ডল। তিনি বলেন, সঠিকভাবে প্রসব না হওয়া, অপুষ্টি, ডায়াবেটিসসহ নানা কারণে মৃত সন্তানে জন্ম হতে পারে। মূলত সচেতনতা এবং সেবাপ্রত্যাশীদের স্বতঃস্ফূর্ত মানসিকতা এ হার কমাতে পারে। তবে ঠিক কী কারণে মৃত সন্তানের জন্ম হয় তার কারণ সাধারণত নথিভুক্ত করা হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সের অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, মূলত দুটি কারণে সিলেট মৃত সন্তান প্রসব বেশি। স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে প্রচারণা হয় তা স্থানীয় ভাষায় হয় না। সিলেটের মানুষ স্থানীয় ভাষার প্রচারণাকে গুরুত্ব দেয় ও বুঝতে পারে। প্রমিত ভাষায় হওয়ার কারণে তারা মনে করে সেগুলো তাদের জন্য নয়। মানুষকে তাদের মতো করে বুঝিয়ে সেবার আওতায় আনতে হবে।