কভিড প্রতিরোধী দ্বিতীয় ডোজ: ১৮ জেলায় মানুষের টিকা নেয়ার হার কম

দেশে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে শুরু থেকেই নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশ্বব্যাপী টিকাদান শুরু হলে গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশেও গণপরিসরে শুরু হয় বিনামূল্যে টিকাদান কর্মসূচি। শুরুতে টিকার সংস্থান নিয়ে কিছুটা জটিলতা সৃষ্টি হলেও পরবর্তী সময়ে কার্যক্রমে গতি ফেরে, শুরু হয় প্রথম ডোজ পাওয়াদের দ্বিতীয় ডোজ দেয়ার কার্যক্রম। দ্রুত দেশের বেশির ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে সরকার। কিন্তু কর্মসূচি শুরু হওয়ার ১১ মাস পেরোলেও দেশের ১৮ জেলার মানুষের টিকা নেয়ার হার এখনো ৩০ শতাংশের নিচে। মূলত নদীভাঙনের শিকার, চর ও হাওরবেষ্টিত জেলাগুলোতেই এ কার্যক্রম পূর্ণ গতি পায়নি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত শনিবার পর্যন্ত দেশে ৮ কোটি ৬৯ লাখ মানুষকে প্রথম ডোজ ও তাদের মধ্যে ৫ কোটি ৬৪ লাখ জনকে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়া হয়েছে। এতে নির্ধারিত জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ মানুষ প্রথম ডোজের টিকা পেয়েছেন। আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন ৪০ শতাংশ মানুষ। আগামী জুনের মধ্যে মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে দুই ডোজ টিকার আওতায় আনতে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। এর মাধ্যমে ১৩ কোটি ৮২ লাখের কিছু বেশি মানুষ দুই ডোজ টিকার আওতায় আসবে।

সরকারের করোনাবিষয়ক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দেশের ১৮টি জেলা এখনো টিকাদানে পিছিয়ে রয়েছে। এসব জেলায় টিকাদানের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের ৫০ শতাংশের কম প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছেন। আর দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৩০ শতাংশেরও কম। মূলত হাওর, চরাঞ্চল, নদীভাঙনের শিকার জেলাগুলোই টিকাদান কার্যক্রমে পিছিয়ে রয়েছে।

এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা দ্বিতীয় ডোজ টিকাদান কার্যক্রমে সব থেকে পিছিয়ে রয়েছে। এ জেলায় ২৫ শতাংশ মানুষ পূর্ণাঙ্গ টিকার (দুই ডোজ) আওতায় এসেছেন। ৩০ শতাংশের কম দ্বিতীয় ডোজ টিকার আওতায় আসা জেলাগুলোর মধ্যে সিলেট বিভাগের চারটি জেলাই রয়েছে। বাকিগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগের তিনটি করে ছয়টি জেলা, রংপুরের চারটি, ঢাকার দুটি, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগের একটি করে দুটি জেলা রয়েছে।

সুনামগঞ্জে ২৬ শতাংশ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হবিগঞ্জ, গাইবান্ধা, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলার দ্বিতীয় ডোজ টিকার হার ২৭ শতাংশ। ২৮ শতাংশ টিকা পেয়েছেন ভোলা, মৌলভীবাজার, সিরাজগঞ্জ ও কুড়িগ্রাম জেলার মানুষ। বাকি ছয়টি জেলায় এ টিকাদানের হার ২৯ শতাংশ। এসব জেলা হচ্ছে নেত্রকোনা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, সিলেট, বগুড়া ও দিনাজপুর।

এসব জেলায় টিকাদানের হার কম হওয়া প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত ভৌগোলিক অবস্থান ও সচেতনতার অভাবেই টিকাদান কার্যক্রমে জেলাগুলো পিছিয়ে রয়েছে। হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুড়িগ্রাম, ভোলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টিকাদান কার্যক্রমে শুরুতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা যায়নি। পরবর্তী সময়ে তাদের মাধ্যমে টিকা গ্রহণের ক্ষেত্রে জনমানুষকে সচেতন করা হয়। নদীভাঙনের শিকার, চরাঞ্চল ও হাওরবেষ্টিত দুর্গম এসব জেলা স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ের মতো টিকা গ্রহণেও পিছিয়ে রয়েছে।

সাধারণ মানুষ টিকা নেয়ার বিষয়ে এখনো শতভাগ আগ্রহী হয়ে ওঠেনি বলে জানান রংপুর বিভাগীয় উপপরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. হাবিবুর রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, কুড়িগ্রামে আমি সিভিল সার্জনের দায়িত্বে ছিলাম। প্রায় ৫০০ চর রয়েছে জেলাটিতে। নদীভাঙনের ফলে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিষয়ক সচেতনতা কম। গত বছরের শেষে আমরা বিশেষভাবে ৪০টি ইউনিয়নে টিকা ক্যাম্পেইন চালাই। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল, মানুষ যেন সচেতন হয়ে টিকার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। এখন বিভাগের সবক’টি জেলায় সম্প্রসারিত টিকা কর্মসূচির নিয়মিত টিকা কেন্দ্রেও সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে কভিড প্রতিরোধী টিকা দেয়া হচ্ছে।

হবিগঞ্জ জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, হবিগঞ্জের দুটি উপজেলা টিকা কর্মসূচিতে পিছিয়ে রয়েছে। জেলাটিতে করোনার সংক্রমণ কম। শুরুতে জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা না থাকায় টিকা কর্মসূচিতে মানুষের আগ্রহও কম ছিল। অবশ্য পরে জনপ্রতিনিধিরা যুক্ত হয়েছেন। এতে স্থানীয় মানুষদের মধ্যে টিকা নেয়ার হার বাড়ছে।

সিলেটের আরেক জেলা মৌলভীবাজারে দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেয়ার হার ২৮ শতাংশ। জেলার সিভিল সার্জন ডা. চৌধুরী জালাল উদ্দিন মুর্শেদ বণিক বার্তাকে বলেন, অগ্রহায়ণে ধান কাটার মৌসুম ছিল। এতে স্থানীয়রা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একই সঙ্গে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনের কারণে টিকাপ্রত্যাশীরা টিকা কেন্দ্রে কম এসেছেন। ফলে আশানুরূপ সাড়া মেলেনি। তবে এখন জোর প্রচার-প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

টিকা কার্যক্রম সারা দেশে একভাবে চলবে না, কোথাও বেশি কোথাও কম থাকাই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, তবে যেসব এলাকায় টিকাদানের হার কম সেখানে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। যারা টিকা নেননি তাদের তালিকা প্রস্তুত করে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। অনেকই প্রথম ডোজ নিয়ে দ্বিতীয় ডোজ নিচ্ছেন না। যখন তালিকা তৈরি করা হবে তখন জানা যাবে কারা টিকা নেননি। তাদের বুঝিয়ে বলতে হবে। এলাকাভিত্তিক কার্যক্রমে গুরুত্ব দিতে হবে।

টিকা কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, সারা দেশে দ্বিতীয় ডোজের টিকা দেয়ার গড় হার ৪০ শতাংশ। তাই এখনই বলার সময় হয়নি যেকোনো জেলা পিছিয়ে। জাতীয় হারের গড় আরো বেশি হলে কোনো জেলা যদি পিছিয়ে থাকে, তখন বলা যাবে কোন জেলা পিছিয়ে রয়েছে। এর পরও আমার পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি।

উল্লেখ্য, দেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণপরিসরে করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগ শুরু হয়। এরপর ৮ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় ডোজের টিকা প্রয়োগ শুরু করা হয়। এ পর্যন্ত দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, সিনোভ্যাক্স ও সিনোফার্মের টিকার প্রয়োগ চলছে। এ পাঁচ টিকা ছাড়াও জনসন অ্যান্ড জনসন, স্পুতনিক-৫ ও সুইডেন অ্যাস্ট্রাজেনেকা টিকা দেশে জরুরি প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। গত বছরের শেষে এসে টিকার তৃতীয় বা বুস্টার ডোজের প্রয়োগ শুরু করে সরকার।

Source: Bonik Barta

Share the Post: