ডায়াবেটিসে টানা ১০ বছর আক্রান্তদের উচ্চরক্তচাপ বেশি

দূষণ, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস ও অস্বাস্থ্যকর জীবনাচারের কারণে দেশে অসংক্রামক ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে। এর মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের মতো রোগগুলোর প্রাদুর্ভাবই এখন সবচেয়ে বেশি। আবার ডায়াবেটিস রোগী উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হলে তা কিডনির জটিলতা ও অন্ধত্বসহ আরো অনেক সমস্যার কারণ হয়ে উঠতে পারে, যা হয়ে উঠতে পারে অকালে প্রাণহানির কারণ। এক যৌথ গবেষণার ভিত্তিতে অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের গবেষকরা জানিয়েছেন, সাধারণত যেসব রোগী ১০ বছর ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, উচ্চরক্তচাপের প্রাদুর্ভাব তাদের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি।

রাজধানীর ছয়টি হাসপাতালের প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ ডায়াবেটিস রোগীর তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গবেষণাটি চালিয়েছেন অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাত বিশেষজ্ঞ। গবেষণায় পাওয়া ফলাফল ‘হাইপারটেনশন অ্যান্ড ইটস রিলেটেড ফ্যাক্টরস অ্যামং পেশেন্ট উইথ টাইপ ২ ডায়াবেটিস মেলিটাস: অ্যা মাল্টি হসপিটাল স্টাডি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে। বিএমসি পাবলিক হেলথ জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়েছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ৬৭ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। বিশেষ করে ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের ৭৮ শতাংশই উচ্চরক্তচাপে ভুগছেন। এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতায় তেমন কোনো তারতম্য দেখা যায়নি। মূলত যারা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিসে ভুগেছেন, তাদের মধ্যেই উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা বেশি। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিসে ভোগা রোগীদের ৭৩ শতাংশই উচ্চরক্তচাপের ভুক্তভোগী। এসব ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে শরীরে ইনসুলিন নিয়েছেন ও ওষুধ সেবন করেছেন। তবে তাতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ডায়াবেটিস আক্রান্তদের মধ্যে কিডনি জটিলতার কারণেও উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা বাড়ছে। আবার শহরাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে কায়িক শ্রমের প্রবণতা কম হওয়ায় তাদের মধ্যেও উচ্চরক্তচাপের প্রাদুর্ভাব বেশি। এছাড়া ধূমপানও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে।

গবেষণায় বলা হয়, বার্ধক্য, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা, দীর্ঘস্থায়ী ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগ টু টাইপ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের উচ্চরক্তচাপের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে স্থূলতা বাড়ছে। এখানে প্রতি পাঁচজনে একজন স্থূলতায় ভুগছেন। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও এখন স্বাভাবিক ওজন ধরে রাখা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

গবেষকদের অন্যতম এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিসের (বারডেম) যুগ্ম পরিচালক সামিরা হুমায়রা হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা আমরা তুলে আনার চেষ্টা করেছি। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে যারা ইনসুলিন নিচ্ছেন বা ওরাল ওষুধ খাচ্ছেন কিন্তু ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে নেই, তাদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা বেশি। একই সঙ্গে যেসব ডায়াবেটিস রোগীর কিডনি রোগ রয়েছে, তাদের মধ্যেও উচ্চরক্তচাপের প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছে।

যত বেশি সময় ধরে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রণে থাকবে, উচ্চরক্তচাপ তত বাড়বে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডায়াবেটিস রোগীর উচ্চরক্তচাপ আরো অনেক দীর্ঘমেয়াদি রোগের জন্ম দিচ্ছে। এতে জীবনের ঝুঁকিও তৈরি হচ্ছে। অন্ধত্ব বাড়ছে, কিডনি রোগসহ নানা জটিলতা সৃষ্টি করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ একটি হরমোন সংশ্লিষ্ট রোগ। দেহযন্ত্র অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট ইনসুলিন তৈরি করতে না পারে, ইনসুলিন নষ্ট হয়ে যায় অথবা শরীর যদি উত্পন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থ হয়, তখন এ রোগের সৃষ্টি হয়। এতে রক্তে চিনি বা শর্করার উপস্থিতিজনিত অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। সাধারণত চার ধরনের ডায়াবেটিস রয়েছে। এগুলো হলো টাইপ-১, টাইপ-২, জেস্টেশনাল ও অন্যান্য। যাদের শরীরে ইনসুলিন নষ্ট হয়ে যায় এবং ইনসুলিন না নিলে মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়, তাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হিসেবে ধরা হয়। টাইপ-২ ডায়াবেটিস হলো ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’ বা দেহে উত্পন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে ব্যর্থতা। শারীরিক কার্যকলাপ ও খাদ্যবিধির সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করা হয়। তবে অনেক সময় প্রয়োজনে মুখে খাওয়ার ওষুধ ও ইনসুলিন ইনজেকশন দিতে হয়। ৪০ বছর বয়সের পর সাধারণত এ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা দেয়। এতে মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় পানীয় ঝুঁকি বাড়ায়। শারীরিক পরিশ্রম না করাও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম একটা কারণ। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগীর ৯০ শতাংশের বেশি টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) বিশ্ব স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রের সমন্বয়ক ডা. বিশ্বজিত ভৌমিক বণিক বার্তাকে বলেন, ডায়াবেটিস যেসব রোগের জন্ম দেয় তাতে উচ্চরক্তচাপ প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। সাধারণত টাইপ-১ ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস দেখা যায়। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ সম্পর্কযুক্ত। ডায়াবেটিস রোগীদের ৫০ শতাংশ সম্ভাবনা থাকে উচ্চরক্তচাপ হওয়ার। একই সঙ্গে উচ্চরক্তচাপের রোগীদেরও ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চরক্তচাপ বাড়ে।

২০০০ সালেও সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ছিল। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা ৬০ শতাংশ বাড়বে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হূদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অন্যদের চেয়ে চার গুণ। ডায়াবেটিস মেলিটাস ও উচ্চরক্তচাপ দুটি আন্তঃসম্পর্কিত রোগ।

আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের হিসাবে, ২০১৯ সালে পৃথিবীতে ৪৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। এর মধ্যে ৭৯ শতাংশ নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক। ২০৪৫ সালে এ সংখ্যা ৭০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশেও দ্রুত হারে বাড়ছে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৮৪ লাখে দাঁড়িয়েছে, যা ২০৪৫ সালে দেড় কোটিতে দাঁড়াবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সঙ্গে যুক্ত হয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি একটি জরিপ পরিচালনা করেছে। জরিপটি প্রকাশের শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দেশের ৪২৬টি উপজেলার এক লাখ জনগোষ্ঠীর ওপর জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এতে ২০ শতাংশ জনসংখ্যার মধ্যে ডায়াবেটিস পাওয়া যায়। আগের চেয়ে ডায়াবেটিসের হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে বলে গবেষণা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক রোগের মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। প্রতি বছর ডায়াবেটিসের কারণে মানুষের মৃত্যু বাড়ছে। চলমান কভিড-১৯ মহামারীতে মৃতদের অর্ধেকই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ডায়াবেটিসের কারণে হূদরোগ, কিডনি রোগ, চোখের রোগ, স্নায়ু রোগ, গর্ভকালীন জটিলতার সৃষ্টি হয়। প্রতিরোধযোগ্য এ অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের সুযোগ রয়েছে। যদিও বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ডায়াবেটিস রোগী নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রার বাইরে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যা কখনো সারে না। কিন্তু এ রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অকালমৃত্যুর হার ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে ডায়াবেটিস। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী মানবমৃত্যুর নবম কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে ডায়াবেটিস।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির (বাডাস) সভাপতি অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ যেমন সম্পর্কযুক্ত, তেমন এর ফলে দীর্ঘমেয়াদি অন্যান্য শারীরিক জটিলতাও সম্পর্কযুক্ত। এখানে টু টাইপ ডায়াবেটিসের কথা বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে এটি প্রতিরোধযোগ্য। একবার হলে তা সারাজীবন থাকবে। তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: