২০২০-২১ অর্থবছর: ওষুধ রফতানি আয়ের ৪০ শতাংশই রেমডিসিভির থেকে

সংকটাপন্ন কভিড-১৯ রোগীদের শারীরিক অবস্থার উন্নতির জন্য রেমডিসিভির জেনেরিকের ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। যদিও এ রোগের বিরুদ্ধে এর কার্যকারিতা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের দাবি, অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে যাওয়া ও শ্বাসকষ্টের সমস্যার ক্ষেত্রে এটি বেশ কাজে দেয়। এর আগে সার্স ও ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করেছিল ওষুধটি। কভিড-১৯ মহামারী শুরু হলে নানা আলোচনা-সমালোচনার পর তা প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসন (এফডিএ), জাপান সরকার ও ইউরোপীয় দেশগুলোর ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সি বিশেষ পরিস্থিতিতে জরুরি ওষুধ হিসেবে রেমডিসিভির ব্যবহারের অনুমোদন দেয়।

বিশ্বে রেমডিসিভির রফতানিকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫৭টি দেশে ওষুধ রফতানি করেছে বাংলাদেশের ৫৩টি ওষুধ প্রস্তুত ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠান। এতে আয় হয়েছে ১ হাজার ৮০১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ বা প্রায় ৭০০ কোটি টাকা এসেছে রেমডিসিভির বিক্রির মাধ্যমে।

এশিয়ার ৪৩টি, দক্ষিণ আমেরিকার ২৬, উত্তর আমেরিকার ছয়, আফ্রিকার ৩৯, অস্ট্রেলিয়ার পাঁচ ও ইউরোপের ৩৮টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হয়। অধিদপ্তর বলছে, নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সংকটাপন্ন রোগীর অবস্থা উন্নতির জন্য কার্যকর ওষুধ হিসেবে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের এসব দেশে বেড়েছে রেমডিসিভির রফতানির পরিমাণ। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসেই রেমডিসিভির রফতানি করে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকার বেশি আয় হয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, ওই অর্থবছরে রেমডিসিভির রফতানি করে ২১৮ কোটি টাকা আয় করে শীর্ষে রয়েছে বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস। ১১৩ কোটি টাকা আয় করে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। এরপর হেলথকেয়ার সাড়ে ৯৬ কোটি, বেক্সিমকো ৬৬ কোটি, এসকেএফ সাড়ে ৬৩ কোটি, জেনারেল ৫০ কোটি, পপুলার ২৫ কোটি ও স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ২২ কোটি টাকার রেমডিসিভির রফতানি করেছে। এছাড়া একমি ও এসিআইসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও রেমডিসিভির জেনেরিকের ওষুধ রফতানি করেছে।

এর আগে ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে বেক্সিমকো, বীকন, এসকেএফ, ইনসেপ্টা, স্কয়ার ও হেলথকেয়ারকে রেমডিসিভির উৎপাদনের অনুমতি দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। পরে বাজারজাত ও রফতানির অনুমতি দেয়া হলে সেপ্টেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে চাহিদা অনুযায়ী ওষুধ পাঠাতে শুরু করে প্রতিষ্ঠানগুলো। পরবর্তী সময়ে আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ওষুধটি উৎপাদনে অনুমতি পায়।

বিশ্বব্যাপী হাসপাতালে ভর্তি সংকটাপন্ন করোনা রোগীদের বাঁচাতে যখন রেমডিসিভির প্রয়োগ শুরু হয়, তখন এর জোগানে ঘাটতি ছিল। তবে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দ্রুত উৎপাদন করে বাজারজাত শুরু করায় বিশ্ববাজারে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে জানান স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের বিপণন বিভাগের মহাব্যবস্থাপক আতিকুজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে যখন রেমডিসিভিরের চাহিদা সৃষ্টি হয়, তখন বিশ্বের বহু দেশই তা উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ওই বছরেই উৎপাদন শুরু করে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান জরুরি ওষুধ সরবরাহে অনেকটা এগিয়ে ছিল। তবে যেহেতু উচ্চপ্রযুক্তি ও অবকাঠামো ছাড়া ওষুধটি তৈরি করা যায় না, তাই সবাই এটি তৈরি করতে পারেনি। ফলে অনেক চাহিদা থাকলেও সে অনুযায়ী সরবরাহ করা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের শতাধিক দেশে নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় রেমডিসিভির ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ওষুধ মানুষের শিরায় প্রবেশ করানোর মাধ্যমে প্রয়োগ করতে হয়। প্রতি ডোজ ওষুধের দাম পড়ে ৫-৬ হাজার টাকা। রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ৫ থেকে ১১ ডোজ রেমডিসিভির প্রয়োগ করা হয়।

বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির (বিএপিআই) মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, সারা বিশ্বেই রেমডিসিভির ওষুধের চাহিদা রয়েছে। গত বছর একটু বেশিই ছিল। সে তুলনায় বিশ্বে রেমডিসিভির উৎপাদক প্রতিষ্ঠান কম ছিল। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের ওষুধের সুনাম রয়েছে। তবে চাহিদা অনুযায়ী জোগান দেয়া যায়নি। এছাড়া রফতানির যে তথ্য ঔষধ প্রশাসন দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি রফতানি হয়েছে। কারণ এ হিসাব শুধু ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে পাওয়া রফতানির হিসাব। এছাড়া বিভিন্ন বৈধ পথ যেমন ব্যক্তিগত আদেশ, সরাসরি ক্রয় আদেশ ও মেধাস্বত্বের সুবিধার কারণে অনেক আয়ের হিসাব এখানে যুক্ত হয়নি। সে হিসেবে আরো বেশি আয় হয়েছে বলেই ধরে নেয়া যায়।

একই কথা বলেছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে অর্ধেকেরও কম রফতানি আয় আসে। বাকি আয়গুলোও বৈধ চ্যানেলে হয়, তবে তা রফতানির হিসাবের মধ্যে থাকে না। ফলে কেবল রফতানি আয়ের হিসাব দিয়ে মোট ওষুধ রফতানির হিসাব জানা সম্ভব নয়।

প্রসঙ্গত, দ্য জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে (জামা) গত বছর প্রকাশিত ‘অ্যাসোসিয়েশন অব রেমডিসিভির ট্রিটমেন্ট উইথ সারভাইভাল অ্যান্ড লেন্থ অব হসপিটাল স্টে অ্যামং ইউএস ভেটেরান্স হসপিটালাইজড উইথ কভিড-১৯’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়, রেমডিসিভির কভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য কোনো ক্লিনিক্যাল সুবিধা দেয় না। অনেকের জন্য এটি শুধু হাসপাতালে থাকার সময় বাড়িয়ে দেয়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: