উচ্চরক্তচাপকে বলা হয় নীরব ঘাতক। কোনো ব্যক্তির রক্তচাপ যখন স্বাভাবিকের (১২০/৮০) তুলনায় বেশি থাকে, তখন তাকে উচ্চরক্তচাপ বলা হয়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস ও মানসিক চাপের কারণে সারা বিশ্বে এ রোগের প্রকোপ বেড়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বাংলাদেশেও ক্রমবর্ধমান হারে অসংক্রামক রোগটির প্রাদুর্ভাব বাড়ছে এবং তা সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে পুরুষদের মধ্যে। গবেষণা বলছে, ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাত বছরে পুরুষদের মধ্যে এ হার বেড়েছে ৫৫ শতাংশ। বিশেষজ্ঞরা সেজন্য বংশগতি ছাড়াও দায়ী করছেন জীবনাচারের পরিবর্তন ও মানসিক চাপকে। প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতার পাশাপাশি বর্ধমান মানসিক চাপ ও কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়াই উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা বাড়ার কারণ বলে মনে করছেন গবেষকরা।
আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের (এএইচএ) হাইপারটেনশন জার্নালে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘এক্সপ্লেনিং দি ইনক্রিজ অব হাইপারটেনশন প্রিভ্যালেন্স ইন বাংলাদেশ ফ্রম ২০১১ টু ২০১৮: এভিডেন্স ফ্রম ন্যাশনাল সার্ভেস’ শীর্ষক গবেষণায় উচ্চরক্তচাপ বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে। দুই বাংলাদেশী গবেষক অস্ট্রেলিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ ফেলো ড. রাকিব ইসলাম ও কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ের রোগতত্ত্বের ওপর পিএইচডি অধ্যয়নরত জুয়েল রানা এ গবেষণাটি করেছেন। সেখানে মূলত ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সরকারের বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ভিন্ন বয়স, শারীরিক ওজন, বাসস্থান ও ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে আক্রান্ত প্রায় ১৪ হাজার ব্যক্তির তথ্য এ গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
গবেষণায় উচ্চরক্তচাপের প্রকোপের পরিবর্তন, প্রথাগত উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকির কারণের পরিবর্তনকে তুলে আনা হয়েছে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপের আলোকে ৩৫ বছর এবং তার বেশি বয়সীদের তথ্য সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সিস্টোলিক রক্তচাপ ও ডায়াস্টোলিক রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য অ্যান্টিহাইপারটেনসিভ ওষুধ গ্রহণের বিষয়টিও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণার ফলাফল বলছে, ২০১১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাত বছরে নারী ও পুরুষদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ বেড়েছে ৫৭ শতাংশ। ২০১৭-১৮ সালে পরিচালিত এক জরিপে পুরুষদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা ছিল ৩১ শতাংশ। আর নারীদের মধ্যে এ হার ছিল ৪৩ শতাংশ। যেখানে ২০১১ সালে পুরুষদের মধ্যে ১৮ শতাংশ আর নারীদের শরীরে ৩০ শতাংশের উচ্চরক্তচাপ পাওয়া যায়। এ সাত বছরে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে পুরুষদের মধ্যেই। এ সময় পুরুষদের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ার হার দেখা গেছে ৫৫ শতাংশ আর নারীদের ২৯ শতাংশ। বিশেষ করে ৩৫ থেকে ৩৯ বছর বয়সী নারী ও পুরুষদের উচ্চরক্তচাপ বাড়ার হার ৮৬ শতাংশ।
শুধু আক্রান্ত হওয়ার হারই নয়, ওই সময়ে এ রোগ হওয়ার পেছনে যেসব প্রথাগত কারণ রয়েছে, তারও পরিবর্তন হয়েছে। গবেষণার অন্যতম গবেষক ও কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে রোগতত্ত্বের ওপর পিএইচডি অধ্যয়নরত জুয়েল রানা বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মূলত ২০১১ ও ২০১৭-১৮ সালের সরকারের দুটি জরিপের আলোকে গবেষণা করেছি। দেখাতে চেষ্টা করেছি কীভাবে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা বাড়ছে। গত কয়েক বছরে মানুষের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন ঘটেছে। আগের মতো শারীরিক পরিশ্রম এখন দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু মানসিক চাপ বেড়েছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণও সেখানে প্রভাব বিস্তার করেছে।
গবেষণা বলছে, উচ্চরক্তচাপ একটি প্রধান দীর্ঘস্থায়ী রোগ। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর জন্য ১৩ শতাংশ ক্ষেত্রে উচ্চরক্তচাপ দায়ী। ২০২৫ সাল নাগাদ এ রোগ বিশ্বব্যাপী ৩০ শতাংশ মৃত্যু বাড়াবে। ক্রমবর্ধমান উচ্চরক্তচাপের বৃদ্ধি বিশ্ব জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। বিশ্বের উচ্চরক্তচাপে ভুক্তভোগীদের চার ভাগের তিন ভাগ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের বাসিন্দা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চৌধুরী মেসকাত আহম্মেদ বণিক বার্তাকে বলেন, গত সাত বছরে পুরুষদের এ রোগ বেড়েছে এমনটিই শুধু নয়, প্রতিনিয়ত এর প্রকোপ বাড়ছে।
বিশ্বের উন্নত দেশে উচ্চরক্তচাপ প্রতিরোধে গুরুত্ব দেয়া হলেও নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে বিষয়টি উপেক্ষিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, পঞ্চাশোর্ধ্বদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ বেশি। যাদের উচ্চরক্তচাপ থাকে, তাদের হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ে।
উচ্চরক্তচাপ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বা রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হওয়া, করোনারি ধমনি রোগ, হার্ট ফেইলিওর, অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন ও পেরিফেরাল ভাস্কুলার রোগের মতো মারাত্মক অবস্থা তৈরির সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন চিকিৎসার বাইরে থাকলে উচ্চরক্তচাপ কিডনি জটিলতা, স্মৃতিভ্রংশ, মস্তিষ্কের জ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা, চোখের ক্ষতি ও বৃক্কের বিকলতা ঘটাতে পারে। যদিও উচ্চরক্তচাপ বংশগত অসুস্থতার একটি। তবে বেশি লবণ গ্রহণ, অতিরিক্ত মেদ, কাজের চাপ, ধূমপান, মদ্যপান, পরিবারের আকার, অতিরিক্ত আওয়াজ ও ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকার কারণে এ রোগের প্রকোপ বাড়তে পারে। এ রোগের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসার দরকার পড়ে।
উচ্চরক্তচাপ একটি অসংক্রামক রোগ। এর কারণে অন্যান্য দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়বে বলে জানান বাংলাদেশ হার্ট ফাউন্ডেশনের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পরিচালক অধ্যাপক ডা. সোহেল রিয়াজ চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, উচ্চরক্তচাপ দুই ধরনের। আমরা ৫ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কারণ জানি। বাকি ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কারণ সুনির্দিষ্টভাবে না জানলেও অনুধাবন করতে পারি। বাংলাদেশে এখন রোগে মৃত্যুর প্রধান কারণ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বা রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় কারণ হলো হূদরোগ। এ দুটিই উচ্চরক্তচাপের কারণে হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ সম্পর্কযুক্ত। ডায়াবেটিসের কারণে যেমন কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। তাতে উচ্চরক্তচাপ আরো প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেও এ রোগের প্রকোপ আরো বাড়ছে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, গত ১০ বছরে দেশে ব্যাপক নগরায়ণ হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা অনিয়ন্ত্রিত। ফলে মানুষের জীবনযাত্রা অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। একই সঙ্গে শহরেও মানুষের বিনোদন ও মানসিক চাপ কমানোর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে পরিবর্তন। বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক এবং অবকাঠামোগত আমূল পরিবর্তনের কারণে জীবনাচারেরও ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে।
উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধযোগ্য উল্লেখ করে জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, উচ্চরক্তচাপ তৈরির জন্য দায়ী কারণগুলোকে আমরা প্রতিরোধ ও প্রশমন করতে পারি। শারীরিক ও মানসিক বিষয়গুলো এর সঙ্গে জড়িত। দেশে এখন অন্যান্য অসংক্রামক রোগও বেড়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো সম্পর্কযুক্ত। একটি দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগ থাকলে অনেক রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
তথ্য বলছে, ২০০০ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে উচ্চরক্তচাপ ছিল। ২০২৫ সালে যা ৬০ শতাংশ বাড়বে। উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দ্বিগুণ। হূদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও চার গুণ বেড়ে যায়। হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ে সাত গুণ।
ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ দুটিতেই আক্রান্তদের হূদরোগ, স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া এমনকি মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে যাওয়ারও শঙ্কা রয়েছে। কিডনি রোগের প্রধান কারণ অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ। ফলে রোগ দুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায়।