রংপুরে শিশুদের মধ্যে বাড়ছে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব

মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি নামের জীবাণুর আক্রমণে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয় অনেকে। প্রায় দুই যুগ আগে দেশে কুষ্ঠরোগ বৃদ্ধির হার কমানোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনো কোনো কোনো অঞ্চলে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। রংপুর অঞ্চলকে এ রোগের শক্তিশালী কেন্দ্রস্থল বলছে সরকার। যদিও সময়ের সঙ্গে এ অঞ্চলের কেন্দ্রস্থলগুলো স্থানান্তরিত হতে শুরু করেছে। পাশাপাশি কেন্দ্রস্থলে শিশুদের মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে বলেই সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে।

গত বছর যুক্তরাজ্যভিত্তিক বায়োমেড সেন্ট্রাল জার্নালে ‘জিওস্পেশাল এপিডেমিওলজি অব লেপ্রসি ইন নর্থওয়েস্ট বাংলাদেশ: আ টোয়েন্টি ইয়ার রেটরোস্পেকটিভ অবজারভেশনাল স্টাডি’ শীর্ষক গবেষণায় শিশুদের মধ্যে কুষ্ঠরোগের প্রকোপ বৃদ্ধির দাবি করা হয়েছে। নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার নয়জন গবেষক গবেষণাটি করেছেন। গবেষণা বলছে, নীলফামারী, পঞ্চগড়, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলায় গত দুই দশকে প্রায় ২১ হাজার জন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছে ও চিকিৎসা নিয়েছে। গত ৩৫ বছর মোট আক্রান্ত রোগীর ৯৫ শতাংশ এ অঞ্চলে বাসিন্দা।

গবেষণা বলছে, গত দুই দশকে এ রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ৩৮ শতাংশ নীলফামারীর, ৩৮ শতাংশ রংপুরের, ১৪ শতাংশ ঠাকুরগাঁওয়ের এবং ১০ শতাংশ পঞ্চগড়ের বাসিন্দা। মোট রোগীর ৪৫ শতাংশ নারী ও ৫৫ শতাংশ পুরুষ। মোট আক্রান্তের আড়াই হাজারের বেশি ১৫ বছরের কম বয়সী। প্রাচীন অবহেলিত কুষ্ঠরোগের এসব কেন্দ্রস্থলে শিশুদের সংক্রমণের হার বেশি। কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তুলনায় উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ১৫ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে সংক্রমণের হার ১৮ শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার বাইরে তাদের মধ্যে ১২ শতাংশ হারে সংক্রমণ ছড়াতে দেখা গেছে।

আক্রান্তদের মধ্যে ২৬ শতাংশই অধিক জীবাণুর (মাল্টিবেসিলারি) ফলে কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছে। ওই অঞ্চলের মোট রোগীর ৫২ শতাংশ কেন্দ্রস্থলের মধ্যে বসবাস করছে। অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কেন্দ্রস্থলে এ রোগ সম্পর্কিত ঝুঁকি ১২ গুণ বেশি দেখা গেছে। কুষ্ঠরোগের কেন্দ্রস্থলের পরিবর্তন হয়েছে উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, ভারতের সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চল, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে।

গবেষণাটির গবেষক ও দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (নীলফামারী) রুরাল হেলথ প্রোগ্রামের (আরএইচডি) প্রধান খোরশেদ আলম বণিক বার্তাকে জানান, মূলত ২০ বছরে যেসব রোগী এ অঞ্চলে চিকিৎসা নিতে এসেছে ও শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শনাক্ত হয়েছে, তাদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রোগটির কেন্দ্রস্থলের পরিবর্তনও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

নীলফামারীর জলঢাকার আট বছরের জান্নাতুল মাওয়া ও সৈয়দপুরের ১২ বছরের আরাফাত আলী কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় দেড় বছর আগে। পরিবারের সদস্যরা কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মধ্যে এ রোগের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। মূলত সচেতনতার অভাবেই তাদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

তারা বলছেন, কুষ্ঠরোগীর হাঁচি-কাশির সময় মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি জীবাণুু বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। কোনো দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ যদি দীর্ঘদিন এ ধরনের রোগীর সান্নিধ্যে থাকে, তাহলে শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ওই জীবাণু গ্রহণ করে এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। শক্তিশালী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকলে জীবাণুর সংস্পর্শে এলেও ৯৫ শতাংশ এ রোগে আক্রান্ত হয় না। স্বাভাবিক শারীরিক সংস্পর্শে এ রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) লক্ষ্যমাত্রা ছিল কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত রোগীর হার প্রতি ১০ হাজারে একজনের নিচে নামিয়ে আনা। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে। দেশে বর্তমানে প্রতি ১০ হাজারে দশমিক ১৫ জন কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ২ হাজার ৭৪৬ জন কুষ্ঠরোগী নতুন করে শনাক্ত হয়েছে। পাশাপাশি এ সময়ে রেজিস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আরো ২ হাজার ৬০১ জন। ফলে দেশে এক বছরে মোট শনাক্ত ও চিকিৎসাধীন কুষ্ঠরোগী রয়েছে পাঁচ হাজার। শুধু রংপুর বিভাগে ৪৯ শতাংশ রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর ১৫ বছরের কম বয়সী রোগী রয়েছে ৬ শতাংশের বেশি, যার ৪৪ শতাংশই রংপুর বিভাগের বাসিন্দা। বর্তমানে দেশে ৩৫ হাজারের বেশি সক্রিয় রোগী রয়েছে। গত ৩৫ বছরে মোট ২ লাখ ৩২ হাজার কুষ্ঠরোগী পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ১৯৮৫ সালে ১২০টি উপজেলায় হাসপাতালভিত্তিক কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হয়। ১০ বছর পর দেশব্যাপী পরিসর বাড়ানো হয়। বর্তমানে ঢাকা, সিলেট ও নীলফামারীতে সরকারিভাবে বিশেষায়িত কুষ্ঠরোগের হাসপাতাল থাকলেও দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যক্ষ্মা ও কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কর্মসূচি চলমান রয়েছে। সরকারের এ কর্মসূচিকে সহায়তা করছে ১০টি বেসরকারি দেশীয় ও অন্তর্জাতিক সংস্থা।

সরকারের কুষ্ঠরোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি ব্যবস্থাপক ডা. মোহাম্মদ ইউনুস আলী বলেন, কক্সবাজার, ঢাকা, সিলেট ও রংপুর অঞ্চলে কুষ্ঠরোগী পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে রংপুর অঞ্চলকে শক্তিশালী কেন্দ্রস্থল হিসেবে ধরা হচ্ছে। দীর্ঘদিন রোগীর সংস্পর্শে থাকার কারণে শিশুদের কুষ্ঠরোগের প্রবণতা বাড়তে পারে।

ডব্লিউএইচও বলছে, কুষ্ঠরোগের জীবাণু শরীরে প্রবেশের পাঁচ বছরের মধ্যে এ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়। লক্ষণ প্রকাশ পেতে ২০ বছরও লেগে যেতে পারে। প্রাথমিকভাবে এ রোগে প্রান্তিক স্নায়ুগুলো, ত্বক, চক্ষু ও শ্বসনতন্ত্রের ওপরের অংশের শ্লেষ্মাঝিল্লি আক্রান্ত হয়। ত্বকে ছোপ ছোপ দাগ, গোটা গোটা দানা ও পরবর্তী সময়ে ক্ষত সৃষ্ট হয়। সেসব অংশে অনুভূতি হ্রাস, বিলোপ, হাত-পায়ে অবশ ভাব, দুর্বলতা, মুখমণ্ডল ও কানের লতিতে ফোলা ভাব দেখা দিতে পারে। চিকিৎসা নেয়া না হলে অঙ্গবিকৃতি বা অঙ্গহানি, হাত-পায়ের নড়াচড়ায় সমস্যা, এমনকি অন্ধত্বের মতো পরিণতি হতে পারে।

দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক শলোমন সুমন হালদার বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা প্রায় দুই যুগ আগে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছি ঠিকই, কিন্তু এখনো অনেক রোগী আছে যাদের কাছে আমরা পৌঁছতে পারিনি। রোগের কেন্দ্রস্থল পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। এতে শনাক্তের কার্যক্রম ও মানুষের স্থানান্তরিত হওয়ার প্রভাব রয়েছে।

দীর্ঘ সময় রোগীর খুব কাছাকাছি থাকার কারণে শিশুরা কুষ্ঠরোগে সংক্রমিত হতে পারে। যেসব কারণে আগে এ রোগ হতো, সেসব এখন নেই বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চর্ম ও যৌন রোগের অধ্যাপক ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার বণিক বার্তাকে বলেন, কুষ্ঠরোগ খুব দ্রুত সংক্রমণ ছড়ায় না। ফলে দৃষ্টির বাইরে থেকে যায়। এ রোগ যক্ষ্মার চেয়েও কম সংক্রমণশীল। তবে শিশুদের মধ্যে সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়ে বড় পরিসরে গবেষণা জরুরি।

Source: Bonik Barta

Share the Post: