দেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর ১১ মাস পর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে গণপরিসরে কভিড প্রতিরোধী টিকাদান কর্মসূচি শুরু করে সরকার। এ কর্মসূচির শুরুতে প্রয়োগ করা হয়েছিল ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে প্রস্তুতকৃত টিকা। এজন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বরেই সেরামের সঙ্গে বাংলাদেশে সরকার ও বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। শুরুতে সব ঠিক থাকলেও ভারতে সংকট দেখা দেয়ায় এক পর্যায়ে বাংলাদেশকে টিকা সরবরাহ বন্ধ করে দেয় সেরাম। এরই মধ্যে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে যে পরিমাণ টিকা বাকি রয়েছে, তা নেয়া হবে কিনা সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত দেয়া হবে বলে সেরামকে জানানো হয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের যৌথ মালিকানার বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের ভ্যাক্সজেভরিয়া নামের করোনার টিকা ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট কোভিশিল্ড নামে তৈরি করছে। সঙ্গে ২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর কোভিশিল্ড টিকার ৩ কোটি ডোজ কেনার জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি হয় সেরামের। প্রতি মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে পাঠানোর কথা ছিল প্রতিষ্ঠানটির। টিকার দাম ও কোল্ড চেইনের (টিকার জন্য নির্ধারিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা) মাধ্যমে বাংলাদেশে পৌঁছানোর মোট খরচ ধরা হয় প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। টিকার প্রথম চালান আসার আগেই অর্ধেক টাকা ব্যাংক গ্যারান্টির মাধ্যমে সেরামকে দেয়া হয়। এতে ৬৩৫ কোটি ৭৭ লাখ ৫৫ হাজার টাকা পায় প্রতিষ্ঠানটি। কোভিশিল্ড টিকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন পাওয়ার পর বাকি টাকা দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। গত বছরের জানুয়ারিতে এ টিকাকে প্রয়োগের অনুমোদন দেয় ডব্লিউএইচও। অর্থ বিভাগের সম্মতি দেয়া ওই ব্যাংক গ্যারান্টিতে বলা হয়েছিল, ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যারান্টির মেয়াদের মধ্যে পাঠানো অর্থের যে পরিমাণ টিকা দিতে সেরাম ব্যর্থ হবে, তার সমপরিমাণ টাকা ফেরত দিতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৫ জানুয়ারি প্রথম চালানে কেনা টিকার ৫০ লাখ ডোজ বাংলাদেশকে পাঠিয়েছিল সেরাম। পরের মাসে ৫০ লাখের বদলে ২০ লাখ ডোজ টিকা পাঠায় তারা। এরপর ভারতে টিকার সংকট ও চাহিদার কথা বলে রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটির সরকার। এরপর ধাপে ধাপে আরো কিছু টিকা পাঠায় সেরাম। সব মিলিয়ে চুক্তির দেড় কোটি ডোজ টিকা বাংলাদেশে পাঠিয়েছে সেরাম। সময়মতো টিকা সরবরাহ করতে না পারায় তার প্রভাব এসে পড়ে বাংলাদেশের করোনা টিকা প্রয়োগের কার্যক্রমের ওপর। টিকা সংকটের কথা বিবেচনা করে এক সময় প্রথম ডোজ প্রয়োগও বন্ধ করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চীনসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে টিকা কেনা হয়। বিভিন্ন উৎস থেকে উপহার হিসেবেও বেশকিছু টিকা আসে। জুন থেকে স্বাভাবিকতা ফেরে দেশের টিকাদান কর্মসূচিতে। এর মধ্যে সেরাম টিকা দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তবে বাংলাদেশের হাতে পর্যাপ্ত টিকা থাকায় সেরামের টিকা নেয়ার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, যখন টিকা দেয়ার বিষয়ে সেরাম আগ্রহ দেখায়, ততদিনে বাংলাদেশের পর্যাপ্ত টিকার সংস্থান হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ সেরামকে পুরো টাকা দেয়নি, কেবল অর্ধেক দেয়া হয়েছিল। ভারতও নিজেদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে প্রয়োজনের সময় সরবরাহ করা বন্ধ করে। পরে যখন টিকা দেয়ার বিষয়ে কথা বলে তখন আমাদের কাছে পর্যাপ্ত টিকা রয়েছে। তাই আমরা বলেছি যে টিকা নেয়া হবে কিনা সে বিষয়ে পরে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, সেরামকে দেয়া টাকার সমপরিমাণ টিকা বাংলাদেশ পেয়েছিল। কিন্তু তারা হঠাৎ করে টিকা দেয়া বন্ধ করে দিলে দেশে সংকট শুরু হয়। যখন বাকি টিকা দেয়ার কথা সেরাম বলে তখন পর্যাপ্ত টিকার সংস্থান হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশ আগ্রহ দেখায়নি। তবে চুক্তির বাকি টিকা নেয়ার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেরামের সঙ্গে চুক্তি পুরোটাই কূটনৈতিক বিষয়। এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যেহেতু যে টাকা দেয়া হয়েছিল তার সমপরিমাণ টিকা পাওয়া গেছে, ফলে আর্থিক বিষয়টি এখানে আর থাকছে না। টিকা না নিলে কিছু আনুষ্ঠানিকতা করে চুক্তি শেষ করা যেতে পারে।
দেশে বর্তমানে টিকার সংকট না থাকায় সেরামকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার বিষয়ে তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, চুক্তিতে কী আছে তা ভালোভাবে বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। এটি কূটনৈতিক বিষয়। আমাদের টিকার সংকট নেই। যথেষ্ট সংস্থান হয়েছে। তবু বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
চুক্তির আওতায় টিকার প্রাপ্তি নিয়ে সর্বশেষ গত মাসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সভা করেছে। অর্থ বিভাগকে সভার সিদ্ধান্তও জানানো হয়। এতে বলা হয়, চুক্তির আওতায় তিন কোটি ডোজ টিকার মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ লাখ টিকা সরবরাহ করে সেরাম। ২০২১-২২ অর্থবছরে ওই চুক্তির ধারাবাহিকতায় সেরামকে ৬০ মিলিয়ন ডলার বা ৫১৬ কোটি টাকা (প্রতি ডলার সমান ৮৬ টাকা) পরিশোধের বিপরীতে আরো ৮০ লাখ ডোজ টিকা সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি অর্থবছরে সেরাম থেকে আসা ৮০ লাখ ডোজ টিকার পরিবহন ব্যয় খাতে ৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসকে দেয়ার জন্য কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) অনুকূলে বরাদ্দের অনুরোধ করা হয়। তবে অর্থ ছাড়ের জন্য বিষয়টি অর্থ বিভাগের পর্যালোচনায় রয়েছে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনবে সরকার। এতে ১৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে টিকা দেয়া হবে। প্রতি জনকে দুই ডোজ টিকা দিতে হলে ২৭ কোটি ৬০ লাখ টিকা প্রয়োজন। পরিকল্পনা ছাড়াও দেশে ১২ বছর ও তার বেশি বয়সী শিশু-কিশোরদেরও টিকা প্রয়োগ চলছে।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড’ টিকা হাতে নিয়ে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করে সরকার। গত নভেম্বরে তৃতীয় ডোজ হিসেবে বুস্টার ডোজ প্রয়োগ শুরু করা হয়। এ পর্যন্ত দেশে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, সিনোফার্ম, সিনোভ্যাক ও জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার প্রয়োগ চলছে। এছাড়া রাশিয়ার স্পুতনিক-৫ ও ভ্যাক্সজেভরিয়া (অ্যাস্ট্রাজেনেকা) টিকা দেশে জরুরি প্রয়োগের জন্য অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দেশে ছয় টিকার সাড়ে ১২ কোটির বেশি প্রথম ডোজ, ৮ কোটি ৫৮ লাখ দ্বিতীয় ডোজ ও সাড়ে ৪০ লাখ তৃতীয় ডোজ প্রয়োগ করা হয়েছে।