প্রশিক্ষণেই পাঁচ বছর পার শিশুবান্ধব হাসপাতাল কর্মসূচির

দেশের হাসপাতালগুলোকে নবজাতক ও শিশুদের উপযোগী করে তুলতে সরকারের রয়েছে বিশেষ কর্মসূচি। একই সঙ্গে নবজাতক ও শিশুদের খাদ্যাভ্যাসে যথাযথ পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করতে সচেতনতা বাড়ানোর জন্যও কার্যক্রম রয়েছে। তবে গত পাঁচ বছর এসব কার্যক্রম শুধু প্রশিক্ষণেই সীমাবদ্ধ। সে প্রশিক্ষণও পাচ্ছেন কেবল হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা। এর বাইরে কোনো প্রায়োগিক কর্মসূচি হাতে নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান। আবার প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও অনেক সময় গোপনীয়তা বজায় রাখা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে।

দেশে জনসাধারণের বিশেষ করে নবজাতক, শিশু, কিশোর ও প্রসূতিদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে জাতীয় পুষ্টি সেবা (এনএনএস) নামের পাঁচ বছর মেয়াদি কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এনএনএসের যে ক’টি কার্যক্রম চলমান তার মধ্যে রয়েছে, শিশুবান্ধব হাসপাতাল এবং নবজাতক ও শিশু খাদ্যাভ্যাস।

এনএনএসের কর্মপরিকল্পনায় (ওপি) মা, শিশু ও কৈশোর পুষ্টিবিষয়ক সচেতনতার বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সেখানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা, আচার ও মনোভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। যার মধ্যে প্রসূতির স্বামী, শাশুড়ি, পরিবারের সদস্য ও ধাত্রীদের পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ রয়েছে। চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতালের অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীকে শিশু ও নবজাতকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের লক্ষ্যে আলাদা প্রশিক্ষণও রয়েছে। একই সঙ্গে লিফলেট, পোস্টার, দেয়াললিখন, পলিসি ব্রিফ, নাটক, ডকুমেন্টারিসহ বিভিন্নভাবে সচেতনতা সৃষ্টিতে কার্যক্রম চালাতে বলা হয়। রয়েছে উঠান বৈঠক ও এলাকাভিত্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময়ের কথাও। শিশুবান্ধব হাসপাতালের ক্ষেত্রে দুগ্ধদানের কর্নার (ব্রেস্টফিডিং কর্নার) স্থাপনের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে এ কর্মপরিকল্পনায়।

কিন্তু শিশুবান্ধব হাসপাতাল কার্যক্রমে উপেক্ষিত রাখা হয়েছে দুগ্ধদানের কর্নার ও প্রচার-প্রচারণার বিষয়টি। শুধু প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই পাঁচ বছরের পুরো সময় পার করেছেন জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কাগজে-কলমে প্রশিক্ষণের বিষয়টি দেখানো হলেও স্থান, প্রশিক্ষণার্থী এবং প্রশিক্ষকদের তালিকা গোপন রাখা হয়েছে।

জানা গিয়েছে, ১৯৯২-৯৪ সালে জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) ও সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষে বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন শিশুবান্ধব হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু করে। এ সময় দেশের ৬৯টি হাসপাতালকে শিশুবান্ধব হাসপাতাল হিসেবে সনদ দেয়া হয়। পরে ১৯৯৫ থেকে ২০০২ সালে কার্যক্রমকে দেশের সমন্বিত পুষ্টি কর্মসূচিতে (বিআইএনপি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যার আওতায় ৩৩০টি হাসপাতালকে শিশুবান্ধব হাসপাতাল বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এরপর ২০১১ সালে তৃতীয় সেক্টর কর্মসূচিতে (এইচপিএনএসডিপি) পাঁচ বছরে আরো ৫৯২টি হাসপাতালকে শিশুবান্ধব করা হয়। বর্তমানে চতুর্থ সেক্টর কর্মসূচিতে (এইচপিএনএসপি) ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত কার্যক্রম চলছে।

জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি ৭২০টি হাসপাতালে শিশুবান্ধব প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৭২টি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৯৫টি হাসপাতালে শিশুবান্ধব হাসপাতালবিষয়ক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ও পুনরুজ্জীবিতকরণ কার্যক্রম চালানো হয়। প্রশিক্ষণের বাইরে অন্য কোনো কার্যক্রমের তথ্য জানাতে পারেনি সরকারের কার্যক্রম বাস্তবায়নকারী এ প্রতিষ্ঠান।

প্রশিক্ষণের বাইরে শিশুবান্ধব হাসপাতাল এবং নবজাতক ও শিশু খাদ্যাভ্যাস কর্মসূচিতে অন্য কার্যক্রম নেই বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্ট উপকর্মসূচি ব্যবস্থাপক (ডিপিএম) ডা. সুপ্তা চৌধুরী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ব্রেস্টফিডিং কর্নার করার দায়িত্ব আমাদের নয়। জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে প্রতি ব্যাচে ১০ জন চিকিৎসক ও ১০ জন নার্স এবং উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে চারজন চিকিৎসক ও ছয়জন নার্সকে চারদিনব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতি ব্যচে ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।

যদিও জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচির পরিকল্পনায় এ কার্যক্রমে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ১ হাজার ২০০ ব্যাচের প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। এর বাইরে মায়ের সহযোগীদের (মাদার সাপোর্ট গ্রুপ-এমএসজি) নিয়ে সাত হাজার প্রশিক্ষণের কথা বলা হয়েছে। অবশ্য গত সাড়ে চার বছরে মাত্র ১ হাজার ৩০০ প্রশিক্ষণ বাবদ বরাদ্দের পুরো টাকায় ব্যয় দেখানো হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, এ দুই কর্মসূচি পরিচালনার দায়িত্বে যারা রয়েছেন, তারা কোথায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন তা সভায় প্রকাশ করেন না। শুধু কতটি প্রশিক্ষণ হচ্ছে তা উপস্থাপন করেন। একই সঙ্গে ব্রেস্টফিডিং কর্নার স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণে কার্যক্রমের কথা কর্মপরিকল্পনায় (ওপি) বলা হলেও তার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। ১০ জন প্রশিক্ষণার্থীর কর্মশালায় আটজন করে প্রশিক্ষক নিয়ে তারা কার্যক্রম চালাচ্ছে বলেও জানা গিয়েছে। আবার প্রশিক্ষকদের তথ্যও প্রকাশ করা হয় না।

প্রশিক্ষণের স্বচ্ছতা থাকে না বলেই সরকারের বড় বড় কার্যক্রমে কর্মকর্তারা আগ্রহী হন বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, বিভিন্ন কর্মপ্রণালিতে যেসব কাজের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে শুধু প্রশিক্ষণকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এর কারণ হলো পাঁচজন প্রশিক্ষণ নিয়ে ১২ জনের কথা লেখা যায়। একদিনের জায়গায় পাঁচদিন লেখা যায়। এখান থেকে খুব বৈধ উপায়ে অর্থের অপচয় করা যায়। একইভাবে কেনাকাটার ক্ষেত্রেও নয়ছয় করা হয়। পুষ্টি কার্যক্রম শুধু প্রশিক্ষণ কেউই সমর্থন করবে না। সচেতনতা বৃদ্ধি ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবকাঠামো প্রস্তুত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাতে দৃষ্টি নেই। বহু বছর ধরে সরকার পুষ্টি কার্যক্রম গুরুত্ব দিয়ে বড় বরাদ্দ রাখলেও যথাযথ পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনার অভাবে তা ভেস্তে যাচ্ছে।

তবে জাতীয় পুষ্টি সেবার (এনএনএস) লাইন ডিরেক্টর ডা. এসএম মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসক, নার্সসহ সেবাদানকারীদের আগে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। চিকিৎসকরা বদলি হওয়ার কারণে বারবার প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে। শুধু কর্নার খুললেই হবে না। এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। আমরা কার্যক্রম চালাচ্ছি বলেই এশিয়া এক্সক্লুসিভ ব্রেস্টফিডিংয়ে (জন্মের ছয় মাস পর্যন্ত) আমরা এশিয়ার মধ্যে এগিয়ে রয়েছি। আমাদের এ হার ৬৫ শতাংশ। এমনিতেই আপনি হাসপাতালসহ সব পাবলিক প্লেসে ব্রেস্টফিডিং কর্নার দেখবেন। তবে এমন কর্নারের সংখ্যা কত এবং তার মধ্যে কতটি ব্যবহারযোগ্য এমন প্রশ্নের সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

এ বিষয়ে অবগত না থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বণিক বার্তাকে বলেন, কোনো বিষয়ে শুধু প্রশিক্ষণ নয়, প্রশিক্ষণ পরবর্তী কার্যক্রম বাস্তবায়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

এদিকে বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সর্বশেষ প্রকাশনায় ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৬-১৭ তিন অর্থবছরের পুষ্টি খাতে সরকারি ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। এতে সরকার ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুষ্টি সম্পর্কিত কর্মকাণ্ডে প্রায় সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে। ব্যয়ের অধিকাংশই পুষ্টি পরোক্ষ কার্যক্রমে ব্যয় হয়েছে, যা মোট বরাদ্দের ৯৮ শতাংশ। পরোক্ষ ব্যয়ের মধ্যে সভা, সেমিনার, সচেতনতা, প্রশিক্ষণ, একটি বাড়ি একটি খামার, ভিজিএফ কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত। মাত্র ২ শতাংশ অর্থ খরচ হতে দেখা গেছে সুনির্দিষ্ট বা প্রত্যক্ষ পুষ্টিবিষয়ক কাজে। যেমন নারীকে আয়রন বড়ি দেয়ার মতো সরাসরি পুষ্টির কাজে বরাদ্দ ও ব্যয় কম। এ কার্যক্রমে তেল পুষ্টিসমৃদ্ধ করা বা লবণে আয়োডিন মেশানোর মতো কাজও অন্তর্ভুক্ত। শুধু ২০১৬-১৭ অর্থবছরেই নয়, ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও পুষ্টিতে বরাদ্দের ৯৮ শতাংশ পরোক্ষ কার্যক্রমে ব্যয় হয়েছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: