স্বাস্থ্য খাতে প্রকট হচ্ছে বৈষম্য। নগর দরিদ্রদের জন্য সুলভ ও সহজপ্রাপ্য চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা যায়নি এখনো। আয়ের অনুপাতে চিকিৎসা খাতে তাদেরই ব্যয় করতে হয় সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে রাজধানীর হতদরিদ্রদের এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে বেশি। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে, স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনামূল্যের সরকারি সুবিধার বাইরেও রাজধানীর হতদরিদ্র বাসিন্দাদের মোট আয়ের এক-তৃতীয়াংশই ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার) করতে হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা খাতে।
অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা, বিশুদ্ধ পানির অপ্রতুলতা, পরিবেশদূষণ, অনিয়ন্ত্রিত শিল্পায়ন ও স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতাই নিম্নবিত্তদের স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বাড়াচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা। রাজধানীর ৩ হাজার ১০০ পরিবারের ১২ হাজারের বেশি ব্যক্তির অসুস্থতা, স্বাস্থ্যসেবা নেয়ার ধরন ও ব্যয় বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষকরা জানিয়েছেন, রাজধানীর দরিদ্রতম বাসিন্দাদের মোট আয়ের প্রায় ৩৩ শতাংশই চলে যাচ্ছে স্বাস্থ্য খাতের ব্যয়ে। জরিপভিত্তিক এ গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পাবলিক লাইব্রেরি অব সায়েন্সের ‘পলোস ওয়ান’ জার্নালে ‘আউট অব পকেট পেমেন্ট ফর হেলথ কেয়ার অ্যামং আরবান সিটিজেনস ইন ঢাকা বাংলাদেশ’ শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে।
অর্থনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় এতে রাজধানীর বাসিন্দাদের পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। এতে দেখা যায়, স্বাস্থ্যসেবা খাতে রাজধানীর বাসিন্দাদের গড় মাসিক ব্যয় আয়ের ৮ শতাংশ। এর মধ্যে অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর ব্যয় হচ্ছে মাসিক আয়ের ৩৩ শতাংশ। দরিদ্র পরিবার ব্যয় করছে ১৩ শতাংশ। এছাড়া মধ্যম আয়ের পরিবার ৮ দশমিক ৩ শতাংশ, ধনীরা ৭ দশমিক ৪ ও অতিধনীরা ৫ দশমিক ২ শতাংশ মাসিক আয় স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যয় করছে। চর্মরোগ, নিউমোনিয়া, ডেঙ্গু, গুটিবসন্ত, টাইফয়েড, জ্বরের মতো সংক্রামক ও অসংক্রামক তীব্র অসুস্থতা, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, গ্যাস্ট্রিক, আলসার, অ্যাজমা, হূদরোগ, কিডনি রোগ, রক্তস্বল্পতা, জন্ডিস, ক্যান্সারের মতো দীর্ঘমেয়াদি এবং কোমর্বিডিটিতে আক্রান্তদের তথ্যকে গবেষণার আওতায় নিয়ে আসা হয়।
স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে গবেষণায় পাঁচ ধরনের উৎসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ১৪ শতাংশ মানুষ সেবা গ্রহণ করছে। বাকিদের মধ্যে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ৩৪ শতাংশ, প্রথাগত মাধ্যমে ৪ শতাংশ ও অন্যান্য উৎস থেকে ৯ শতাংশ মানুষ সেবা নেয়। তবে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে ওষুধের দোকান থেকে। চিকিৎসা ছাড়া শুধু ওষুধের দোকান থেকেই ৩৯ শতাংশ মানুষ সেবা গ্রহণ করছে।
গবেষকদের অন্যতম এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ ড. আব্দুর রাজ্জাক সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা মূলত রাজধানীর নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবার বাড়তি ব্যয় দেখার চেষ্টার করেছি। সরকারিভাবে যে সুবিধা রয়েছে তার বাইরে চিকিৎসা, ওষুধ, রোগ নির্ণয় ও যাতায়াত খরচ এ বাড়তি ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। আয়ের অনুপাতে সবচেয়ে বেশি খরচের হার হতদরিদ্র পরিবারের। এসব পরিবার আয়ের এক-তৃতীয়াংশই স্বাস্থ্যসেবার বাড়তি খরচ হয়। একই সঙ্গে আমরা বলেছি সরকারি, বেসরকারি, প্রথাগত ও ওষুধের দোকান থেকে কত শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেয়। হতদরিদ্র পরিবার খরচ মেটাতে গিয়ে প্রায় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে।
গবেষকদের ভাষ্যমতে, প্রায় ২৩ শতাংশ অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন অসুস্থতায় ভুগছিলেন, যাদের অধিকাংশেরই অসুস্থতার মাত্রা তীব্র। শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব ও সম্পদের অভাব, বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের বিস্তারের জন্য অনুকূল পরিবেশ এসব রোগের কারণ হতে পারে। অভিবাসন ও দ্রুত নগরায়ণের ফলে গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে নতুন রোগ দেখা যায়। নতুন অবকাঠামোর জন্য রাস্তার ধুলা, টেক্সটাইল ও ডাইং ব্যবসা, ট্যানারি, রাসায়নিক, সিমেন্টের কারখানা ও দূষণের ভারী ধাতুর উপস্থিতি রোগের বৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। ঢাকায় বায়ুদূষণের কারণে ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ও শারীরিক অক্ষমতার ঝুঁকি রয়েছে। শহুরে নাগরিকদের অ্যালার্জি, প্রদাহজনিত ও মানসিক ব্যাধি শক্তিশালী। গবেষণায় অংশ নেয়া ৩১ শতাংশ ব্যক্তি দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতায় ভুগছে। দীর্ঘমেয়াদি এসব রোগ মৃত্যুর ঝুঁকি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেশে বার্ষিক মৃত্যুর ৫৪ শতাংশ এসব অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণে হয়ে থাকে।
সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রাথমিক ও জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা শহরের নাগরিকদের জন্য অপ্রতুল উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. নাসরিন সুলতানা বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা থাকলেও শহরে এমন কোনো অবকাঠামো নেই। কমিউনিটি বেজড (গোষ্ঠীগত বা মহল্লাভিত্তিক) প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামো শহরে নেই বললেই চলে। গ্রামীণ কাঠামোয় যেমন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, শহরে তেমন নেই। কিছু বিশেষায়িত ব্যবস্থা থাকলেও প্রাথমিক ও কমিউনিটি বেজড সেবার ব্যবস্থা নেই। ফলে বড় বড় সরকারি হাসপাতাল বা বেসরকারি হাসপাতালের ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। ঢাকায় অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে যাতায়াত খরচ বেশি। একই সঙ্গে দালালদের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। জেলা বা উপজেলা শহরে রোগ নির্ণয়ের খরচ আর রাজধানীতে রোগ নির্ণয়ের খরচ এক নয়। যতক্ষণ শহরের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবার জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় অবকাঠামো ও সুবিধা চালু করা না যাবে ততক্ষণ হতদরিদ্রদের ব্যয় কমানো যাবে না। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যবীমা চালু করা আবশ্যক।
ভালো আবাসন ব্যবস্থা না পাওয়া, দূষিত পরিবেশ, নিম্নমানের খাবার ও বিনোদন না থাকার কারণে হতদরিদ্ররা রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, ধনীরা জীবনধারণের জন্য যেসব সুবিধা পাচ্ছে, দরিদ্ররা সেসব সুবিধা পাচ্ছে না। তারা যেমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের মধ্যে থাকছে, তেমনি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যও ভালো নয়। একই সঙ্গে খরচের কারণে তারা রোগ নির্ণয়েও বিলম্ব করে। ফলে তাদের ব্যয়ও হচ্ছে বেশি।
জাতীয় স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের আহ্বায়ক ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বণিক বার্তাকে বলেন, সামাজিক অবস্থান ও শ্রেণীবৈষম্যের কারণে ধনী ও দরিদ্ররা সরকারি ব্যবস্থাপনায় একই ধরনের সেবা পায় না। অনেক ক্ষেত্রে সব শ্রেণীর মানুষের সরকারি ব্যবস্থাপনার সেবা পাওয়ার ধরন ও মান এক নয়। আবার এ দরিদ্ররা অর্থের অভাবে বেসরকারি সেবাও পাচ্ছে না। সামাজিক বৈষম্যের কারণে দরিদ্র পরিবারে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বেশি হতে পারে। যার আর্থিক অবস্থা ভালো, সব ব্যবস্থাপনার সেবা তার জন্য ভালো। যার আর্থিক অবস্থা খারাপ, তার জন্য কোনো ব্যবস্থাপনা নেই।