জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: শিশু সুরক্ষায় দুর্বল দেশের ১০ জেলা

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম দিকে। তৈরি হচ্ছে নানা জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি সংকট। খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, বন্যার মতো দুর্যোগের প্রভাব পড়ছে দেশের শিশুদের ওপর। শিশু সুরক্ষা সূচকে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত না হওয়া, বাল্যবিবাহ, যথাযথ সময়ে জন্মনিবন্ধন না হওয়া, সহিংসতা, শিশুশ্রম ও নির্যাতনের মধ্যে পড়ছে শিশুরা। জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যে উঠে এসেছে, দেশের ১০ জেলায় শিশু সুরক্ষা দুর্বল। সংস্থাটির মতে, মূলত জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে এসব অঞ্চলে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি।

ইউনিসেফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শিশু সুরক্ষার পরিমাপকে পিছিয়ে থাকা জেলাগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে নড়াইল। বাকিগুলো হলো নেত্রকোনা, মাগুরা, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হবিগঞ্জ, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও পটুয়াখালী জেলা। এসব জেলার শিশুদের মৌলিক অধিকার শতভাগ নিশ্চিত করা যায়নি। সহিংসতা ও নিপীড়নের মধ্যেও রয়েছে এসব এলাকার শিশুরা। একই সঙ্গে শৈশবে মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে তাদের প্রতি প্রারম্ভিক যত্ন ও বিকাশের বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।

এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের অন্তত ১১টি জেলা বিপর্যয়ের শীর্ষে রয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এসব জেলা হলো কক্সবাজার, নোয়াখালী, সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, দিনাজপুর, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড়।

ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিভাগের প্রধান ন্যাটালি ম্যাকউলি এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, শিশুর জন্মনিবন্ধন, শিশু ও নারীদের প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, স্কুলের বাইরে শিশুদের সংখ্যা নিয়ে সারা দেশের জেলাগুলো বিশ্লেষণ করা হয়। এতে শিশু সুরক্ষা দুর্বলতার দিক থেকে দেশের ১০ জেলার অবস্থান শীর্ষে দেখা যায়।

জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে ক্ষতির মুখে পড়া ১১ জেলার বিষয়ে তিনি বলেন, এসব জেলা ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পড়া অঞ্চলে দুই কোটি শিশু বাস করছে। জলবায়ু বিপর্যয়ের চিহ্নিত জেলাগুলোর শিশুদের প্রতি সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ ক্ষতিকর বিষয়গুলো স্পষ্ট। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যস্ত এলাকায় নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণের ঝুঁকি বেশি। দেশের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় শিশু সুরক্ষার উদ্বেগ কমাতে ও সমাজসেবামূলক কর্মীদের শক্তিশালী করতে সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে ইউনিসেফ।

শিশুরা জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্য দায়ী না হলেও তারা ক্ষতির মুখে পড়ছে উল্লেখ করে ইউনিসেফ বলছে, শিশুদের জন্য জলবায়ু ঝুঁকি সূচক বা চিলড্রেন্স ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্সে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৩ দেশের মধ্যে ১৫তম। বাংলাদেশে প্রতি তিনজন শিশুর মধ্যে একজন বিরূপ আবহাওয়া, বন্য, নদীভাঙন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। ফলে তারা শহরে এসে বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে। যেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিত করা যায়নি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপর্যস্ত অঞ্চলে শিশুরা সহজেই শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহের শিকার হয়। দেশের ১৭ লাখ শিশু কোনো না কোনোভাবে শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত। যাদের মধ্যে প্রতি চারজনের একজনের বয়স ৬ থেকে ১১ বছর। এসব শিশু সহজেই সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।

ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ শিশু (শূন্য থেকে আঠারো বছর)। এসব শিশুর ৮৯ শতাংশ বাড়িতেই সহিংসতার শিকার হচ্ছে। শিশুদের সহিংসতা ও নির্যাতনের কারণে সপ্তাহে ২০টি শিশুর মৃত্যু হয়। ৫১ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হচ্ছে ১৮ বছরের আগেই। একই সঙ্গে শিশুশ্রম ও স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সংস্থাটি বলছে, শিশু ও নারীদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ এগিয়েছে। কমেছে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, স্কুল থেকে ঝরে পড়া, লৈঙ্গিক বৈষম্য, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার। বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ ও মৌলিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায়ও উন্নতি করেছে। তবে জলবায়ুর ঝুঁকিতে থাকায় এসব বিষয়ের উন্নতি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। আবার শিশুমৃত্যুর হার কমলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ অবস্থার আর উন্নতি হয়নি।

শিশু সুরক্ষা নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের মতে, শিশুর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন, সহিংসতা, বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করা, শিশুশ্রম, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত না হওয়ার মতো বিষয়গুলো সুরক্ষা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া জরুরি। এ বিষয়ে সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার বিভাগের পরিচালক আব্দুল্লাহ আল মামুন বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের সব জেলায়ই শিশু সুরক্ষার বিষয়ে কাজ করা হয়। তবে সুরক্ষার ক্ষেত্রে কিছু না কিছু দুর্বলতা রয়েছে। বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তনে শীর্ষে থাকা জেলাগুলোয় শিশু সুরক্ষা কম। শিশুদের ওপর খরা, বন্যা, নদীভাঙন, লবণাক্ততা, বাস্তুচ্যুত হওয়ার মতো বিষয়গুলোর প্রভাব রয়েছে। তবে জলবায়ু বিপর্যয় শিশু সুরক্ষার দুর্বলতার একমাত্র কারণ নয়।

তার মতে, শিশু সুরক্ষার বিষয়ে কোনো কোনো পরিমাপকে বাংলাদেশ উন্নতি করলেও কিছু বিষয়ে এখন পিছিয়ে রয়েছে। এখন শিশু সুরক্ষার জন্য অনলাইন নিরাপত্তা ও সমবয়সীদের দ্বারা যৌন নির্যাতন প্রতিরোধ গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে পিছিয়ে থাকা সব জেলা একই কারণে শিশু সুরক্ষায় পিছিয়ে থাকছে না। কোনো জেলায় বাল্যবিবাহ বেশি। আবার কোনো জেলায় শিশুশ্রম ও নির্যাতন বেশি।

ইউনিসেফ বলছে, এখনো যথাসময়ে জন্মনিবন্ধনের আওতায় আসেনি বাংলাদেশে বহু শিশু। মোট শিশুর ৩৭ শতাংশকে জন্মনিবন্ধনের আওতায় আনা গেছে। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধির কারণে ফসলের খেতে লবণাক্ত পানি প্রবেশের কারণে ফসল নষ্ট হচ্ছে। নিরাপদ পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙনের ফলে বাস্তুচ্যুত হচ্ছে মানুষ। তারা গৃহপালিতসহ অন্যান্য সম্পদ হারিয়ে ফেলছে। ফলে তারা বাসস্থানের খোঁজে শিশুদের নিয়ে শহরে পাড়ি জমায়। যেখানে মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে পাঁচ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। ২০৫০ সালে যা মোট জনসংখ্যার অর্ধেকে দাঁড়াবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু বিপর্যয়ের অনেক সাধারণ চিহ্ন রয়েছে। তবে সবকিছুকে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাঁধ ভেঙে গেছে বলার চেয়ে বাঁধটি সঠিকভাবে নির্মাণ হয়েছিল কিনা, তা দেখা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের কিছু জেলায় কোনো না কোনো কারণে শিশুদের সুরক্ষা দুর্বল। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তা আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। শিশুদের সুরক্ষার জন্য সেসব এলাকায় আরো মনোযোগ দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত মনে করেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে শিশুরা ক্ষতির মুখে পড়েছে এমনটি বলার আগে দেখতে হবে তারা কেন বিপর্যয়ের মুখে পড়ল। তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কোথাও বিপর্যয় কম আবার কোথাও বেশি। কোনো বিপর্যয় হলে শিশু ও নারীরা বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দেখা যাবে দরিদ্র শিশুদের মধ্যে পুষ্টির অভাব রয়েছে। কিন্তু দোষারোপ করা হলো জলবায়ু পরিবর্তনকে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওইসব এলাকার মানুষ ক্ষতির মুখে অবশ্যই পড়ছে। তবে শিশু সুরক্ষা ব্যাহত হওয়ার মুখ্য কারণ জলবায়ু পরিবর্তন নয়। কারণ শিশু সুরক্ষার ব্যাহত হওয়ার মধ্যে দারিদ্র্য, অনিরাপত্তা, শিক্ষার অভাব, অব্যবস্থাপনাসহ অনেক কারণ রয়েছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: