দেশে মৃতদের মধ্যে শতকরা চারজন অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শ্বাসনালির দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত এ রোগে মৃত্যুর সঠিক কারণ পরিপূর্ণভাবে জানা যায়নি। মানুষের শ্বাসনালি ধুলাবালির সংস্পর্শে আসার কারণে শ্বাসকষ্টের উদ্রেক হওয়াকে অ্যাজমা বলা হয়। অসংক্রামক এ রোগের কারণে শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে মৃত্যু বেশি হয়। শুধু অ্যাজমা নয়, নিউমোনিয়া, ফুসফুসের সংক্রমণসহ শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগে শহরাঞ্চলের চেয়ে গ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি—এমন তথ্য উঠে এসেছে সরকারি পরিসংখ্যানে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূলত অপরিকল্পিতভাবে গ্রামাঞ্চলকে শহরাঞ্চলের দিকে ঠেলে দেয়া, তৃণমূলের চিকিৎসা অবকাঠামোর দুর্বলতা, চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে অসমতা ও অবহেলার কারণে গ্রামাঞ্চলে শ্বসনতন্ত্র ও ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগে মৃত্যু বেশি।
প্রতি বছর বিভিন্ন সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগসহ নানা কারণে শহর ও গ্রামের মানুষের মৃত্যু হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূলত মৃত্যুর কারণ হিসেবে ১৫ রোগে বার্ষিক স্থূল মৃত্যুহার প্রকাশ করে। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস ২০২০’ বলছে, দেশে প্রতি এক হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ৫ দশমিক ১ জনের মৃত্যু হয় ওই ১৫টি কারণে। তবে এর মধ্যে শহরের চেয়ে গ্রামে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি। বছরে প্রতি হাজারের মধ্যে ৫ দশমিক ২ জন গ্রামাঞ্চলের আর ৪ দশমিক ৯ জন শহরাঞ্চলের বাসিন্দা।
বিবিএস বলছে, হার্ট অ্যাটাক, হূদরোগ, মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ, শ্বসনতন্ত্রের রোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, লিভার ক্যান্সার, কিডনি রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, সাধারণ সর্দি-জ্বর, ডায়াবেটিস, ব্লাড ক্যান্সার, পক্ষাঘাত, সড়ক দুর্ঘটনা ও অন্যান্য কারণে প্রতি হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ৫ দশমিক ১ জনের মৃত্যু হয়। তবে এসব কারণে শহরের চেয়ে গ্রামে মৃত্যু হয় বেশি। শতাংশের হিসাবে শ্বাসরোগে শতকরা নয়জনের বেশি মারা যান গ্রামের বাসিন্দা। আর শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে এ রোগে মৃত্যু হয় আটজনের। প্রতি ১০০ জনের মধ্যে অ্যাজমায় পাঁচজন গ্রামের বাসিন্দার মৃত্যু হয়। আর শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে তিনজন এ রোগের কারণে মারা যান। সংক্রামক রোগ নিউমোনিয়ায় গ্রামাঞ্চলে প্রতি ১০০ জনে পাঁচজনের বেশি ব্যক্তির মৃত্যু হলেও শহরে এ রোগে চারজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া লিভার ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ, সাধারণ জ্বর, ব্লাড ক্যান্সারে গ্রামের মানুষের মৃত্যুর হার বেশি।
জানা যায়, বিশ্বের উন্নয়নশীল ও উন্নত দেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বাংলাদেশে ৮০ লাখের বেশি অ্যাজমা রোগী রয়েছে। সব বয়সের ব্যক্তির মধ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ফুসফুসের বায়ুথলিতে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট ও কাশি হওয়ায় হাজার বছরের প্রাচীন ও প্রচলিত রোগ নিউমোনিয়া। প্রতি বছর সারা বিশ্বে এ রোগে আক্রান্ত ৪৫ কোটির মধ্যে ৪০ লাখের মৃত্যু হয়। আর নাক থেকে শুরু করে ফুসফুস পর্যন্ত শ্বাসনালির মধ্যে যেকোনো ধরনের সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগের বিস্তারের মাধ্যমে শ্বসনতন্ত্রের রোগের সৃষ্টি হয়।
বিবিএসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮০ বছর বা তার বেশি বয়সের প্রতি এক হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ৮৪ জন এ ১৫টি কারণে মারা যায়। ৭৫ থেকে ৭৯ বছরের মধ্যে ৬৮, ৭০ থেকে ৭৪ বছরের মধ্যে ৪৪, ৬৫ থেকে ৬৯ বছরের মধ্যে ২৭ জন এবং এক বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে ২৫ জন এসব কারণে মারা যায়।
মেডিসিন ও রেসপিরেটরি মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্বসনতন্ত্রের রোগ, ফুসফুসের জটিলতা, নিউমোনিয়া এবং অ্যাজমায় ভুগে মৃত্যুর সংখ্যা গ্রামে বেশি হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ রয়েছে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতা। এসব রোগে শিশুমৃত্যুর হার বেশি। একই সঙ্গে ষাটোর্ধ্বরাও এ রোগে বেশি মারা যান। শহরের চেয়ে গ্রামেই শিশু ও ষাটোর্ধ্বরা অবস্থান করেন। একই সঙ্গে গ্রাম ও শহরের চিকিৎসাসেবার অবকাঠামো এবং সেবা প্রাপ্তির বিষয়ে অসমতা রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনীয় ওষুধের ঘাটতিও গ্রামে বেশি।
শহরের চেয়ে দূষণমুক্ত পরিবেশ ও ভেজালমুক্ত খাবার গ্রহণের পরও গ্রামে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে চিকিৎসা ব্যবস্থার অসামঞ্জস্যতা দেখছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. একেএম মোশাররফ হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা আর শহরের চিকিৎসা ব্যবস্থা এক নয়। চিকিৎসার অপ্রতুলতা ও অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে গ্রামের বাসিন্দারা অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা পান না। শহরের বাসিন্দারা প্রতি ছয় মাসে না হলেও বছরে একবার শরীরের রোগ নিরীক্ষণের সুযোগ পান। শহরে সরকারি বা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে এসব সুযোগ রয়েছে। তবে গ্রামে ওষুধের দোকানের ওপরই বাসিন্দাদের নির্ভর করতে হয়। নিয়মিত ‘চেকআপ’ না হওয়া এসব রোগে মৃত্যুর অন্যতম কারণ। কেননা শুরুতে রোগ নিরীক্ষণ করা গেলে তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রোগ চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হওয়ার পর গ্রামের বাসিন্দারা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেন।
তবে চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের মানুষের অসচেতনতাও মৃত্যুহার বেশি হওয়ার কারণ বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রামে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার কারণ হলো মানুষের সচেতনতার অভাব। মানুষ চিকিত্সকের কাছে না গিয়ে হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে যায়। চিকিত্সকের পরামর্শ ছাড়া দোকান থেকে ওষুধ কিনে খায়। শহরের মতো গ্রামে চিকিৎসা না পাওয়া গেলেও গ্রামীণ অবকাঠামোতে যেসব চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তা থেকে যথাযথ সেবা নিতে পারলে মৃত্যুহার কিছুটা কম থাকত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রামে প্রয়োজনীয় জরুরি ওষুধের স্বল্পতা রয়েছে। সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ প্রয়োগ জরুরি উল্লেখ করে তারা বলছেন, নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ জরুরি। অনেক ক্ষেত্রে অক্সিজেন সাপোর্ট প্রয়োজন হয়। কিন্তু গ্রামে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায় না। উপজেলা হাসপাতালে অক্সিজেন, আইসিইউ বা ভেন্টিলেটর সুবিধা পাওয়া যায় না। কোনো কোনো জেলা হাসপাতালেও এমন জরুরি সেবা নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই যে গ্রামে মৃত্যুহার বেশি তা সঠিক নয়। ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত এখন অনেক চিকিৎসা পাওয়া যায়। এর পরও জরুরি প্রয়োজন হলে টারশিয়ারি পর্যায়ে (বিশেষায়িত) হাসপাতালে পাঠানো হয়। আগের চেয়ে মৃত্যুহার এখন কমেছে। দেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। এখন উপজেলা হাসপাতালেও ভালো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ দেয়া হয়।