ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকার চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল

গত বছরের শেষে বান্দরবানের লামা উপজেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গর্ভবতী এক নারী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে আসেন। তিনি নভেল করোনাভাইরাসেও আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসা ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে প্রয়োজনীয় জরুরি সেবা পাননি সন্তানসম্ভবা ওই নারী। ম্যালেরিয়ার জীবাণু তার হূিপণ্ডে রক্ত চলাচলে বাধা সৃষ্টি করে। ঘাটতি দেখা যায় অক্সিজেনেরও। ফলে গর্ভেই প্রাণ হারায় সন্তান। মৃত্যুবরণ করতে হয় তাকেও। বাংলাদেশে ম্যালেরিয়া রোগীর ৭০ শতাংশের বেশি বান্দরবানের বাসিন্দা। কিন্তু সংকটাপন্ন রোগীদের চিকিৎসা প্রাপ্তিতে সেখানে রয়েছে চরম ঘাটতি। অপ্রতুল চিকিৎসাসেবার কারণে আক্রান্তদের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। যদিও সরকারের তথ্য বলছে, গত নয় বছরে ম্যালেরিয়ায় মারা যাওয়া রোগীর ৫২ শতাংশই চট্টগ্রামের।

সরকারি তথ্যমতে, ২০০৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সারা দেশে ৫ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে সংকটাপন্ন হয়ে মারা গেছেন ৬৪৩ জন। দেশে বর্তমানে ১৩টি জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব রয়েছে। তবে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে আক্রান্তের হার সর্বোচ্চ। আক্রান্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি বান্দরবানের দুর্গম এলাকার বাসিন্দা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত নয় বছরে ২ লাখ ২২ হাজার ব্যক্তির শরীরে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে বান্দরবানে ১ লাখ ৯ হাজার, রাঙ্গামাটিতে ৬৮ হাজার, খাগড়াছড়িতে প্রায় ২৩ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। বান্দরবানে রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি চট্টগ্রামে। ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত নয় বছরে সারা দেশে ১৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ২ হাজার ৭৯৩ জন ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলেও মারা গেছেন ৬৮ জন রোগী। এরপর বান্দরবানে ৩০ জন,

খাগড়াছড়িতে ১৯, কক্সবাজারে পাঁচ ও রাঙ্গামাটি, নেত্রকোনা, ময়মনসিংহে দুজন করে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। আর একজন করে দুজনের মৃত্যু হয়েছে সিলেট ও সুনামগঞ্জে।

সরকারের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বান্দরবানের সাতটি উপজেলার মধ্যে আলীকদম, থানচি ও লামায় ম্যালেরিয়ার সর্বোচ্চ সংক্রমণ রয়েছে। জেলার ৭৫ শতাংশ ম্যালেরিয়া রোগী এ তিন উপজেলার বাসিন্দা। একইভাবে রাঙ্গামাটির ১০ উপজেলার মধ্যে বাঘাইছড়ি, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়িতে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। মূলত দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত বেশি হচ্ছে। খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটিতে রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও চিকিৎসাসেবা অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট জেলার স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তারা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এনোফিলিস জাতীয় স্ত্রী মশা ম্যালেরিয়া জীবাণুর বাহক। এ মশা কামড় দিলে জ্বর হওয়ার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে মারাত্মক লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। অনেকের কাঁপুনি দিয়ে জ্বরও আসতে পারে। অজ্ঞান হওয়া, অস্বাভাবিক ও অসংলগ্ন আচরণ করা, বারবার খিঁচুনি হওয়া, অত্যধিক দুর্বলতা, বারবার বমি হওয়া, শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের বুকের দুধ বা অন্য খাবার খেতে না পারা ম্যালেরিয়ার লক্ষণ। ম্যালেরিয়ার কারণে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়। রক্তকণিকার মধ্যে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে তার মৌলিক কাঠামো নষ্ট করে দেয়। তাতে পুরো শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যায়। মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হলে কিডনি ও লিভার পর্যন্ত বিকল হয়ে যায়। ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের শুরুতেই চিকিৎসা দেয়া না গেলে খুব দ্রুতই মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি হয়।

বান্দরবান সিভিল সার্জন ডা. নীহার রঞ্জন নন্দী বণিক বার্তাকে জানান, অক্সিজেনের ব্যবস্থা যা আছে তাতে অক্সিজেনস্বল্পতায় ভোগা রোগীদের সেবা দেয়া যায়। কিন্তু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) না থাকায় সংকটাপন্ন রোগীদের বান্দরবানে চিকিৎসা দেয়া কঠিন। তাই জেলার সংকটাপন্ন ম্যালেরিয়া রোগীদের চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। তাছাড়া ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তদের রোগ নির্ণয় অনেক সময় করা যায় না। জেলায় প্রায় ১০০ কমিউনিটি ক্লিনিকে ম্যালেরিয়া নির্ণয়ের ব্যবস্থা আছে। অনেকে অবহেলা করে চিকিৎসা ও রোগ নির্ণয়ের জন্য আসে না।

তিনি বলেন, শুরুতেই যাদের ম্যালেরিয়া শনাক্ত করা যাচ্ছে, তাদের সহজেই সুস্থ করে তোলা যায়। ম্যালেরিয়াপ্রবণ উপজেলাগুলো দুর্গম হওয়ায় রোগীদের ব্যবস্থাপনা জটিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ খলিলুর রহমান বলছেন, বিশেষ করে ম্রো সম্প্রদায়ের মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসা বা ওষুধ নিতে চান না। তাদের নিজস্ব চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করার প্রবণতা রয়েছে। তাদের অবস্থা যখন খুবই মারাত্মক হয়, তখন তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। এতে সঠিক তথ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে মৃত্যুর তথ্যগুলো চট্টগ্রাম জেলার অনুকূলে যুক্ত করা হয়।

তিনি বলেন, এর মধ্যে গত দু-তিন বছরে চট্টগ্রামে মৃত্যুর প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেড়েছে। মূলত ফটিকছড়ি এলাকায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েছে। এ অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার সংক্রমণ কমে যাওয়ায় বিষয়টি নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ম্যালেরিয়াপ্রবণ তিন পার্বত্য জেলার ম্যালেরিয়া চিকিৎসার তেমন ব্যবস্থা নেই। সংকটাপন্ন ম্যালেরিয়া রোগীর জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), হাই ফ্লো অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অকেজো হয়ে গেলে ডায়ালাইসিসের প্রয়োজন হয়।

স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পঞ্চাশের দশকে পাহাড়ি অঞ্চলে ম্যালেরিয়ার মৃত্যু দেখা গেলেও ষাটের দশকে ম্যালেরিয়া নির্মূলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারি তত্পরতা শুরু হয়। পরে দুই দশকের বেশি সময় ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামে কার্যক্রম চালিয়ে নেয়া যায়নি। ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাক কার্যক্রম শুরু করে। ২০০৫ সালের মধ্যে সংস্থাটি ২৫টি উপজেলায় কাজের পরিধি বাড়ায়। ২০০৩ সাল থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) নেতৃত্বে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর কাজ শুরু হয়। ২০০৭ সালে গ্লোবাল ফান্ড টু ফাইট এইডস, টিউবারকিউলোসিস অ্যান্ড ম্যালেরিয়া প্রকল্পের আওতায় ম্যালেরিয়া নির্মূলে জোর তত্পরতা শুরু হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, বাংলাদেশে ১৩ ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকার মধ্যে তিন পার্বত্য জেলা এখনো ‘রেড জোন’ হিসেবে চিহ্নিত। এসব জেলার দুর্গম এলাকায় ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা পৌঁছানো যায়নি। একই সঙ্গে সরকারি পর্যায়ে লোকবলেরও অভাব রয়েছে। তিন জেলার সবখানে একই রকম সংক্রমণ নেই। সংক্রমণের শীর্ষে থাকা উপজেলাগুলোর দুর্গম এলাকায় যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে জলপথ। ফলে যারা আক্রান্ত হয় তারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দ্রুত আসতে পারছেন না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির সংকটাপন্ন রোগীদের পরিবহন করা সম্ভব হলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। অনেকে এখানে এসে মৃত্যুবরণ করে। তাই চট্টগ্রামে মৃত্যুর সংখ্যাটা বেশি দেখা যাচ্ছে। ৩০ বছর আগেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা বেশি হতো। ফলে ম্যালেরিয়া রোগীর ব্যবস্থাপনার জন্য এ হাসপাতালের এক ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সেজন্য বান্দরবানে রোগীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হলেও স্থানীয় হাসপাতালগুলো যখন দেখে রোগীর অবস্থা বেশ খারাপ, তখন তাদের চট্টগ্রামে পাঠানো হয়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: