শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য দরকার প্রয়োজনীয় পুষ্টি। কিন্তু শৈশবের শুরুতেই প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হলে তা শিশুর যথাযথ বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। জন্মের ছয় মাস পর থেকে মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি পুষ্টি পূরণের জন্য প্রয়োজন বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার। বাংলাদেশে ছয় থেকে ২৩ মাস বয়সী সিংহভাগ শিশুর নিয়মিত খাদ্যতালিকায় পুষ্টি উপাদানের বৈচিত্র্য নেই। ফলে পুষ্টির ঘাটতির মধ্যেই অতিবাহিত হয় তাদের প্রারম্ভিক শৈশব। যার প্রভাব বয়ে বেড়াতে হয় সারা জীবন। বাংলাদেশে ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়সী ৬৬ শতাংশ শিশু পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার পায় না বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। মূলত খাদ্যনিরাপত্তার অভাব, পুষ্টি সম্পর্কে শিশুর বাবা-মায়ের জ্ঞান ও সচেতনতা না থাকার ফলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সম্প্রতি ইউনিসেফের প্রকাশিত ‘দ্য স্টেট অব দ্য ওয়ার্ল্ডস চিলড্রেন ২০২১ অন মাই মাইন্ড; প্রমোটিং, প্রটেক্টিং অ্যান্ড কেয়ারিং ফর চিলড্রেনস মেন্টাল হেলথ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ছয় থেকে ২৩ মাস বয়সী শিশুদের ৬৬ শতাংশ নিয়মিত খাবারে ন্যূনতম বৈচিত্র্য পায় না। এর মধ্যে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের ৭৮ শতাংশ ও ধনী পরিবারের শিশুদের ৫২ শতাংশ পুষ্টিসম্মত খাবারের বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত।
ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশে বাড়ন্ত শিশুদের বয়স উপযোগী পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো এক ধরনের সীমাবদ্ধতা। অনেক বাবা-মা তাদের শিশুদের মায়ের দুধের পাশাপাশি সম্পূরক খাবার কীভাবে ও কখন খাওয়াতে হয় সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। যদিও প্রারম্ভিক শৈশবের বিকাশের জন্য পুষ্টিকর খাবার অতি জরুরি। নবজাতকের জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ বা শাল দুধ খাওয়ানোর হারই এখনো ৫০ শতাংশ হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার বলতে শর্করা, আমিষ, চর্বি, খনিজ, ভিটামিনসহ বিভিন্ন উপাদানসমৃদ্ধ খাবারকে বোঝানো হয়। দেশের মানুষ ভাতকে বেশি গুরুত্ব দেয়, সেই সঙ্গে আলু। এতে শুধু শর্করা পাওয়া যায় এবং তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। তবে চর্বি, আমিষ ও খনিজের ঘাটতি পূরণের জন্য অন্য খাবারকে কম গুরুত্ব দেয়া হয়। শাক-সবজি, ভাত, মাছ, মাংস, ডিম, ফলমূল দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টির বৈচিত্র্য পূরণ করে। শিশুদের ক্ষেত্রে ছয় মাসের পর বৈচিত্র্যপূর্ণ এসব খাবার খাওয়াতে হয়।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের অসুস্থতার অন্যতম কারণ উচ্চমাত্রার পুষ্টিহীনতা। মূলত খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ও পুষ্টি নিয়ে অভিভাবকদের জ্ঞান ও সচেতনতার অভাবের কারণে শিশুদের বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার দেয়া হয় না। বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণে এক-চতুর্থাংশ শিশু বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার পায় না। উপযোগী পরিপূরক খাবার না পাওয়ার তালিকায় শহরের বস্তি ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী এগিয়ে রয়েছে। মাত্র এক-তৃতীয়াংশ শিশু বয়স অনুসারে সম্পূরক খাবার পায়। বাংলাদেশের মায়েরা নিজ সন্তানের জন্য ফর্মুলা বা প্রক্রিয়াজাত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের শিশু খাদ্য পছন্দ করেন। শিশুকে মাছ ও মাংস খাওয়ানোর ক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে এখনো কুসংস্কার রয়েছে। ফলে বাড়িতে প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার থাকলেও তা শিশুদের দেয়া হয় না।
শিশুদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ইশতিয়াক মান্নান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে শিশুর খাবারে বৈচিত্র্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ শুধু শর্করাজাতীয় খাবারের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবার ভাত-ডালের বাইরে আসছে না। দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো না গেলে পুষ্টির ঘাটতি পূরণ করা কঠিন। এর পাশাপাশি শিশুর মা-বাবাকে পুষ্টির বিষয়ে সচেতন করতে হবে। কী, কখন ও কীভাবে খাওয়াতে হবে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় অনেক ক্ষেত্রে ঘরে পুষ্টিকর খাবার থাকলেও তা শিশুরা পায় না।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদ ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ন্যাশনাল নিউট্রিশন প্রোফাইল বলছে, জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে ৪৭ শতাংশ শিশু মায়ের বুকের দুধ পায়। আর ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ পায় ৬৩ শতাংশ শিশু। বয়স অনুযায়ী উচ্চতা বাড়েনি বা খর্বতা রয়েছে পাঁচ বছরের কম বয়সী ২৮ শতাংশের, শারীরিকভাবে দুর্বল বা কৃশকায় শিশু ১০ শতাংশ ও বয়স অনুযায়ী ওজন কম ২৩ শতাংশ শিশুর।
বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, একটি শিশুকে সুস্থ ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে হলে প্রথম এক হাজার দিনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হয়। মায়ের গর্ভধারণ থেকে শিশুর দুই বছর পর্যন্ত এ সময়কে আমরা গোল্ডেন থাউজ্যান্ড ডেজ বলি। এ সময় প্রয়োজনীয় পুষ্টি নিশ্চিত করতে পারলে ওই শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ শক্তিশালী হয়। শিশুর বিকাশের জন্য এ সময়ের পুষ্টি প্রায় ৯০ ভাগ কাজ করে।
তিনি বলেন, জন্মের পর ছয় মাস পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ ছাড়া শিশুকে পানি পর্যন্ত খাওয়ানো যায় না। ছয় মাস পর মায়ের দুধের পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের মতো শিশুকে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবার দিতে হবে। দরিদ্র পরিবারের শিশুদের শুধু ডাল মাখা ভাত দেয়া হয় অথবা শুধুই ভাত। বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের ক্ষেত্রে যে সচেতনতা ও সক্ষমতা প্রয়োজন তা সবার মধ্যে নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রারম্ভিক শৈশবেই শিশুদের খাদ্যাভ্যাস গড়ে ওঠে। বাংলাদেশে এ সময়ের জন্য পুষ্টি কার্যক্রম কম। শিশুদের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে ও টিকা দিতে হবে তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা কিছুটা সৃষ্টি করা গেলেও পুষ্টির বিষয়ে ঘাটতি রয়েছে।
বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তার ঘাটতি আগের মতো নেই বলে মনে করেন সরকারের জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন মাহমুদ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, খাদ্যনিরাপত্তা আগের চেয়ে বাড়লেও পুষ্টি নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেক মা-বাবা শিশুদের প্রক্রিয়াজাত খাবার দেন। অনেক শিশুকে শুধু সুজি, বার্লি, খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। আমরা যে খাবার খাই তা শিশুদের দেয়া হয় না। আমরা মানুষকে পরিপূর্ণভাবে সচেতন করতে পারলে শিশুদের জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের অভাব নিরসন করা যাবে। এতদিন আমরা পরিপূরক ও সম্পূরক খাবারের মধ্যেই ছিলাম। এখন বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের বিষয়টি আমরা আরো স্পষ্ট করেছি। এ বিষয় নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের সঙ্গে কাজ করছে। সরকারও বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে।