দেশে প্রতি বছরই ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এখানে প্রাদুর্ভাবের দিক থেকে ক্যান্সারের অন্যতম শীর্ষ ধরন হলো মুখগহ্বরের ক্যান্সার। জিহ্বা, মুখের আস্তরণ, ঠোঁট, মাড়ি, গলা, গলার পেছনের অংশ বা স্বরযন্ত্র ক্যান্সারে আক্রান্ত হলে মোটা দাগে সেটিকেই মুখগহ্বরের ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওয়ার্ল্ড ক্যান্সার রিসার্চ ফান্ড ইন্টারন্যাশনালের (ডব্লিউসিআরএফ) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গোটা বিশ্বে মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্তদের মৃত্যুহার বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি।
কোষের অনিয়ন্ত্রিত বিভাজনজনিত জটিলতাগুলোকে সামষ্টিকভাবে ক্যান্সার হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সাধারণ কোনো কার্যকর ওষুধ উদ্ভাবন না হওয়ায় রোগটিকে বিবেচনা করা হয় মরণব্যাধি হিসেবে। প্রায় ২০০ ধরনের ক্যান্সার রয়েছে। এর মধ্যে সাধারণ একটি ধরন হলো মুখগহ্বরের ক্যান্সার।
ডব্লিউসিআরএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বব্যাপী ৭ লাখ ৪৪ হাজার ৯৯৪ জন মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। গোটা বিশ্বে মুখগহ্বরের ক্যান্সার শনাক্তের হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০২০ সালে দেশে সাড়ে ৩০ হাজার মুখগহ্বরের ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। জনসংখ্যার বিপরীতে শনাক্তের বয়স-প্রমিত হার (বিভিন্ন বয়সসীমায় আক্রান্তের হারের ভারযুক্ত গড় বা এএসআর) প্রতি লাখে ২১ জন। আক্রান্তের সংখ্যার দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকলেও মৃত্যুর হারে শীর্ষে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে দেশে ১৬ হাজার ৮৮৪ জন মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। বয়স-প্রমিত হারে এ মৃত্যুহার দাঁড়ায় প্রতি লাখে ১১ দশমিক ৯ জনে। পুরুষ রোগীদের মৃত্যুহার প্রতি লাখে ১৭ দশমিক ৪ জন। নারী রোগীদের ক্ষেত্রে তা প্রতি লাখে ৬ দশমিক ১ জন।
বিশ্বব্যাপী মুখগহ্বরের ক্যান্সারের সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে দায়ী করা হয় তামাক ও অ্যালকোহল সেবনকে। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই তামাক ও অ্যালকোহল মুখগহ্বরের ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে জানিয়েছে ডব্লিউসিআরএফ। এছাড়া এর সঙ্গে এইচপিভি গোত্রের ভাইরাসেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এছাড়া অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার সঙ্গেও মুখগহ্বরের ক্যান্সারের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার বণিক বার্তাকে বলেন, মুখগহ্বরের ক্যান্সার মূলত তামাক ও অ্যালকোহল সেবনের কারণে হয়ে থাকে। তামাক যে প্রক্রিয়ায়ই সেবন করা হোক না কেন তা মুখগহ্বরের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াবে। ধূমপান, পানের সঙ্গে সুপারি-জর্দা-চুন ব্যবহার, গুল সেবন—এসবই মুখগহ্বরের ক্যান্সারের প্রধান কারণ। তামাকের ব্যবহারের কারণে দেশে নারী ও পুরুষ উভয়ই এ ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। এর সঙ্গে অ্যালকোহল ও এইচপিভিও জড়িত। দেশে তামাকের ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। আবার তামাকের ব্যবহার কমাতে হলে শুধু বললেই হবে না। মানুষের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি করতে হবে। এজন্য সরকারের যেসব সংস্থা তামাক নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে, তাদের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। তবে এখন যে ক্যান্সার বেশি হচ্ছে, তা বলা কঠিন। আগেও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার ছিল। তবে প্রয়োজনীয় নির্ণয় পদ্ধতি এবং সচেতনতার বাইরে থাকায় তা আমাদের দৃষ্টির বাইরে ছিল। তখন যেসব ক্যান্সার কম দেখা যেত, তা এখন বেশি করে দেখা যাচ্ছে।
বৈশ্বিক মানবমৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হিসেবে ক্যান্সারকে দায়ী করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি ছয়টি মৃত্যুর একটির জন্য দায়ী হলো ক্যান্সার। ২০১৮ সালে এতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রায় ৯৬ লাখ।
ডব্লিউএইচওর ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) বলছে, ২০২০ সালে দেশে ১ লাখ ৫৬ হাজার ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। অন্যদিকে ওই বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার। দেশের মানুষের মধ্যে প্রধানত ৩৫ ধরনের ক্যান্সার দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় খাদ্যনালির ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব। মোট আক্রান্তদের ১৪ শতাংশেরই খাদ্যনালির ক্যান্সার হয়েছে। ৯ শতাংশ রোগী নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে ঠোঁট, মুখ ও মুখগহ্বরের ক্যান্সার। স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছে ৮ শতাংশ রোগী। নারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় জরায়ু ক্যান্সার।
শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বেই এখন ক্যান্সারের রোগী বাড়ছে। ডব্লিউএইচও বলছে, প্রতিরোধমূলক কৌশল অবলম্বন করলে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে ক্যান্সারের মৃত্যু রোধ করা যায়। রোগ ব্যবস্থাপনা ও ক্যান্সার রোগীর প্রাণরক্ষার জন্য প্রাথমিক পর্যায়েই শনাক্ত করার পাশাপাশি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ খুবই জরুরি। কিন্তু নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় এমন রোগের চিকিৎসা ও প্রতিরোধের সুযোগ কম। এসব দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায়সহ সার্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপরেই চাপ বাড়ছে।
সব ধরনের তামাক সেবন ও ধূমপান এড়িয়ে চলা, প্রচুর ফল ও সবজিসহ স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম এবং অ্যালকোহল সেবন এড়িয়ে চলা মুখগহ্বরের ক্যান্সার প্রতিরোধের সবচেয়ে ভালো উপায় বলে মনে করছেন ক্যান্সার রোগতত্ত্ববিদরা। তামাক জাতীয় পণ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকলে মুখগহ্বরের ক্যান্সার অন্তত ৮০ শতাংশ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সারওয়ার আলম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, মুখের ক্যান্সারের আরো কারণ রয়েছে। মুখের হাইজিনও গুরুত্বপূর্ণ। মুখ পরিষ্কার ও যথাযথভাবে দাঁতের যত্ন না নিলেও এ ক্যান্সার হতে পারে। বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে মুখের হাইজিন নিয়ে সচেতনতা কম। উন্নত দেশগুলো এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দেয় বলে সেসব দেশে মুখগহ্বরের ক্যান্সার নেই। দাঁতের যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগ মুখের ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। পান, সুপারি ও চুন খাওয়া, গুল, জর্দা, বিড়ি-সিগারেট, অ্যালকোহল ও এইচপিভি মুখের ক্যান্সারের কারণ।
বিশ্বব্যাপী প্রাদুর্ভাবের দিক থেকে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের মধ্যে মুখগহ্বরের ক্যান্সারকে ষষ্ঠ অবস্থানে রাখছে যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা (এনএইচএস)। বিশেষজ্ঞদের ভাষ্যমতে, নারীদের তুলনায় পুরুষদের মধ্যে এ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। পুরুষরা নারীদের তুলনায় তামাক ও অ্যালকোহল বেশি পান করার কারণ হতে পারে। মুখের ক্যান্সার অল্পবয়স্কদের মধ্যে বিকশিত হতে পারে। এইচপিভি ভাইরাসের সংক্রমণ অল্পবয়সী ব্যক্তিদের মুখের ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে।
ক্যান্সার চিকিৎসায় একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ)। ক্যান্সারের চিকিৎসা প্রার্থী রোগীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই এখানে চিকিৎসা নিতে আসেন। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে হাসপাতালটিতে ৭৬ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এর মধ্যে ৩৫ হাজার ৩৬৯ জনের মধ্যে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। যারা এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন প্রধানত তাদের তথ্যই এ পরিসংখ্যানে তুলে আনা হয়েছে। যদিও এর বাইরে দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই থেকে আড়াই লাখ বলে ধারণা করছেন প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞরা।
ডব্লিউসিআরএফ মুখগহ্বরের ক্যান্সারের যে চিত্র দেখিয়েছে তা সঠিক হলে বিষয়টি ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বাংলাদেশে অ্যালকোহল সেবনের মাত্রা কম। মুখের ক্যান্সারের মূল কারণ তামাক সেবন। সরকার অনেক আগে থেকে তামাকমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা দিয়েছে। সরকার একদিকে তামাকমুক্ত করতে চাইছে। অন্যদিকে তামাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কৌশলে তাদের ব্যবসা বাড়াচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের মাধ্যমে তামাকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সরকারের উচিত বিদ্যালয়গুলোয় সুস্বাস্থ্য নিয়ে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান ও চর্চা চালু করা। সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা শুরু থেকেই স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হবে।
বিশ্বে মুখগহ্বরের ক্যান্সার আক্রান্তের হারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে পাপুয়া নিউগিনি। ডব্লিউসিআরএফের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে ২০২০ সালে প্রায় দেড় হাজার রোগী শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তের বয়স-প্রমিত হার প্রতি লাখে ২৫ দশমিক ৭ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। তৃতীয় ও চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে রোমানিয়া ও হাঙ্গেরি। এছাড়া এ তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে থাকা অন্য দেশগুলো হলো যথাক্রমে কিউবা, স্লোভাকিয়া, ভারত, শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও মলদোভা। পাপুয়া নিউগিনি আক্রান্তের হারে শীর্ষে থাকলেও মৃত্যুহারে দ্বিতীয় অবস্থানে। তৃতীয় অবস্থান থেকে দশম অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে মলদোভা, পাকিস্তান, রোমানিয়া, হাঙ্গেরি, ভারত, বেলারুশ, স্লোভাকিয়া ও মন্টেনিগ্রো।