কভিড-১৯ টিকাদান: ডব্লিউএইচওর লক্ষ্য অর্জিত হলে বিশ্বে মৃত্যু হতো অর্ধেক

করোনা মহামারী শুরুর প্রায় এক বছর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণপরিসরে টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। এর পরও পর্যাপ্তসংখ্যক টিকার সংস্থান না হওয়ায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি অনেক দেশে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরামর্শ অনুযায়ী টিকাদান কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা গেলে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা অর্ধেকে নেমে আসত বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। টিকাদান কার্যক্রমের শুরু থেকেই পিছিয়ে রয়েছে মূলত মধ্যম ও নিম্ন আয়ের দেশগুলো। যদিও টিকা প্রাপ্তিতে সমতা আনতে ডব্লিউএইচওর নেতৃত্বে কোভ্যাক্স এসব দেশে চাহিদার এক-পঞ্চমাংশ টিকা দেয়ার কার্যক্রম হাতে নিয়েছিল।

‘গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট অব দ্য ফার্স্ট ইয়ার অব কভিড-১৯ ভ্যাকসিনেশন: আ ম্যাথমেটিক্যাল মডেলিং স্টাডি’ শীর্ষক এক গবেষণায় টিকাদান কর্মসূচির প্রভাব নিয়ে এমন তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে গবেষণা নিবন্ধটি প্রকাশ করা হয়েছে গত মাসে। গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ অব লন্ডনের ছয় গবেষক। বিশ্বের ১৮৫টি দেশে কভিড-১৯-এর সংক্রমণ ও টিকাদানের সংগৃহীত তথ্য গাণিতিক মডেলে বিশ্লেষণের ভিত্তিতে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।

গবেষকরা বলছেন, শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে পরবর্তী এক বছরে কভিডে অন্তত ১ কোটি ৮১ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। টিকা না দেয়া হলে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। তবে টিকা কার্যক্রম চালানোর কারণে এ সময়ে বিশ্বে অন্তত দেড় কোটি মৃত্যু কমানো সম্ভব হয়েছে। ডব্লিউএইচওর পরামর্শ অনুযায়ী গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত যে ক’টি দেশ তার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষকে টিকা দিয়েছে, সেগুলোয় অনেক মৃত্যু প্রতিরোধ করা গিয়েছে।

স্মিট সায়েন্স ফেলোশিপের আওতায় পরিচালিত এ গবেষণার অর্থায়নে আরো সহযোগিতা করেছে রোডস ট্রাস্ট, ডব্লিউএইচও, যুক্তরাজ্যের মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল ও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ রিসার্চ, গ্যাভি-দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ও কমিউনিটি জামীল।

করোনার দ্বিতীয় বছরে টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনার কারণে আগের বছরের তুলনায় মৃত্যু কমেছে ৬৩ শতাংশ। তবে ডব্লিউএইচওর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গত বছর ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিটি দেশ তার জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষকে পূর্ণাঙ্গ (দুই ডোজ) টিকা দিতে পারলে মৃত্যু অর্ধেকে নামিয়ে আনা যেত।

তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষকে টিকা দেয়া হয়। তবে সমানভাবে বিশ্বের সব দেশই এ কার্যক্রম চালাতে পারেনি। টিকার বৈশ্বিক সংকট বিভিন্নভাবে দেশগুলোর টিকাদান কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে গত বছরের শুরুতে টিকাদানের প্রভাব নিয়ে প্রচারাভিযান ও উপযুক্ত অবকাঠামোর সংকটের কারণেও টিকা কার্যক্রম বাধার মুখে পড়ে। দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় টিকার সংকটের মধ্যেও পড়ে কোনো কোনো দেশ। টিকার কারণে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি বা প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি হওয়ার বিষয়ে গবেষণা নিয়ে ছিল নানা সংশয়। টিকা সরবরাহের সীমাবদ্ধতার কারণে বেশির ভাগ দেশ সম্মুখসারির (স্বাস্থ্যকর্মী ও বয়স্ক ব্যক্তিসহ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ) জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেয়। এতে গণপরিসরে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়নি।

ডব্লিউএইচওর করোনা টিকা প্রদান কৌশল অনুযায়ী, গত বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রতিটি দেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ মানুষকে টিকাদান কর্মসূচির আওতায় আনার কথা ছিল। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৪০ শতাংশ ও ২০২২ সালের জুনের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়ার জন্য প্রতিটি দেশকে পরামর্শ দিয়েছিল। গত নভেম্বরের শুরুতে বিশ্বের ৫৬টি দেশ সেপ্টেম্বরের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পিছিয়ে ছিল, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অনুজীব বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, টিকা দেয়ার মাধ্যমে তৈরি হওয়া প্রতিরোধী শক্তি শরীরে প্রবেশকারী অনুজীবকে নিষ্ক্রিয় করে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে টিকাটা যদি আমরা বেশি মানুষকে ও অধিক মাত্রায় দিতে পারতাম তাহলে মৃত্যুর হার আরো কমত।

আফ্রিকা অঞ্চলের ৪৪টি দেশ ডব্লিউএইচওর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হলে অঞ্চলটিতে কভিড-১৯ আক্রান্তদের ৭৪ দশমিক ৯ শতাংশ মৃত্যু এড়ানো যেত। একইভাবে আমেরিকা ও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের ১৩টি করে মোট ২৬টি দেশে টিকাদান কার্যক্রমের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এ দুই অঞ্চলে মৃত্যু এড়ানো যেত যথাক্রমে শূন্য দশমিক ১৪ শতাংশ ও ১৩ শতাংশ। ইউরোপেরও ১৩টি দেশে পূরণ হয়নি টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা। এ কারণে সেখানে শূন্য দশমিক ৭১ শতাংশ মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হয়নি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাতটি ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পাঁচটি দেশে টিকাদান কার্যক্রম কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। ফলে অঞ্চল দুটিতে যথাক্রমে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ ও শূন্য দশমিক ২ শতাংশ অতিরিক্ত মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে, যা টিকা দেয়া হলে এড়ানো যেত।

গতকাল পর্যন্ত বিশ্বে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৬৩ লাখ ৩৭ হাজারের বেশি মানুষের। বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ৫৪ কোটি ৮৪ লাখ। আর বাংলাদেশে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ১৯ লাখ ৭৫ হাজার অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৯ হাজার ১৬০ জন করোনা রোগী।

করোনার টিকা প্রয়োগে সরকারের জাতীয় পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা কর্মসূচির আওতায় আনবে সরকার। তবে পরবর্তী সময়ে ১২ থেকে ১৮ বছরের কিশোরদেরও টিকাদান কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করে সরকার। এখন ৫ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত শিশুদেরও টিকা দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

গবেষণায় তথ্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্বের বহু দেশ পর্যাপ্তসংখ্যক টিকা পায়নি। আফ্রিকার কিছু দেশ তাদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে পারেনি। ফলে করোনার নতুন নতুন ধরন সৃষ্টি হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। সংক্রমণের বিস্তার ঠেকানো না গেলে ধরন ও উপধরন তৈরি হয়। টিকা দিলে আক্রান্তের মৃত্যুঝুঁকি কম থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যত দ্রুত সম্ভব বেশিসংখ্যক মানুষকে টিকা কার্যক্রমের আওতায় আনতে হবে। এতে করোনায় সংক্রমিত হলেও রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হবে না। একই সঙ্গে শুরুতে যাদের টিকা দেয়া হয়েছে, তাদের আবারো বুস্টার ডোজ বা নতুন করে দুই ডোজ টিকা দেয়া উচিত। তাদের দেয়া টিকার কার্যকারিতা দিন দিন কমে আসছে। তবে সবার টিকা দেয়া সম্পন্ন হলেই শুধু এ উদ্যোগ নিতে হবে।

সরকারের তথ্য বলছে, দেশে গতকাল পর্যন্ত প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ১২ কোটি ৯০ লাখের বেশি মানুষ। আর দ্বিতীয় ডোজের টিকা পেয়েছেন ১১ কোটি ৯৬ লাখের কিছু বেশি প্রথম ডোজ গ্রহণকারী। তাদের মধ্যে তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ নিয়েছেন ২ কোটি ৯১ লাখ ৮৫ হাজার ব্যক্তি। বাংলাদেশে করোনার টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ডা. শামসুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশে টিকা দেয়ার হার নিয়ে আমরা সন্তুষ্ট। এ পর্যন্ত প্রথম ডোজ নিয়েছেন ৭৬ শতাংশ আর দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৭১ শতাংশ মানুষ। তবে তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ একটু কম রয়েছে। প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ বুস্টার ডোজ নিয়েছেন। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কখনই ৮০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেয়া যায় না। কারণ সব বয়সীদের করোনার টিকা দেয়া হয় না।’

প্রাপ্তবয়স্কদের টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও এখন শিশুদের দিকে সরকারের মনোযোগী হওয়া উচিত বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, ৫ থেকে ১২ বছরের শিশুদের অতিদ্রুত টিকার আওতায় আনা উচিত। সেক্ষেত্রে মৃত্যু আরো কমে যাবে। শিশুদের মৃত্যুর প্রধান কারণ নিউমোনিয়া। আর করোনায় আক্রান্ত হলে শিশুদের নিউমোনিয়া প্রভাবিত হয়।

উল্লেখ্য, দেশে গত ৭ ফেব্রুয়ারি গণপরিসরে নভেল করোনাভাইরাসের টিকা প্রয়োগ শুরু হয়। দেশে জরুরি প্রয়োগের জন্য আটটি টিকা অনুমোদন দিয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। এগুলো হলো অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার-বায়োএনটেক, মডার্না, সিনোফার্ম, জনসন অ্যান্ড জনসন, সিনোভ্যাক্স, স্পুতনিক-৫ ও সুইডেন অ্যাস্ট্রাজেনেকা।

Source: Bonik Barta

Share the Post: