দেশের বিভিন্ন এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে মৃদু তাপপ্রবাহ। এতে তীব্র গরমে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে মানুষকে। গতকাল রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বছরের প্রায় আট মাসই দেশজুড়ে এমন তাপমাত্রা বজায় থাকে। অধিকাংশ ওষুধই ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। এ অবস্থায় দোকানগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ব্যতিরেকে ওষুধ সংরক্ষণের জন্য উপযুক্ত নয়। যদিও ঢাকার ৮০ শতাংশ ওষুধের দোকানেই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। এছাড়া ঢাকার বাইরের জেলাগুলোয় অবস্থা আরো করুণ।
ওষুধ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের ৯০ শতাংশ ওষুধই ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে সংরক্ষণ করতে হয়। পাশাপাশি ঠাণ্ডা ও শুকনো স্থানে আলোর আড়ালে রাখতে হয়। তবে বাংলাদেশে গরমের সময় সাধারণত ২৭ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। কোনো কোনো সময় তাপমাত্রা প্রায় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও পৌঁছে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ওষুধের জন্য উপযোগী তাপমাত্রা বজায় রাখতে পারে না ওষুধের দোকানগুলো। একই সঙ্গে অধিকাংশ ফার্মেসির বিক্রেতারা ওষুধ সংরক্ষণের যথাযথ নির্দেশনা জানেন না। ওষুধ ভেদে সংরক্ষণের জন্য সঠিক তাপমাত্রা নিয়েও তাদের ধারণা নেই। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ওষুধের কার্যকারিতা নষ্ট হয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষিত না হওয়ার কারণে এ ওষুধ সেবনে স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ওষুধ প্রযুক্তি ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, দেশে সাধারণ কোনো রোগের উপসর্গ দেখা দিলে ওষুধের দোকান থেকে অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের মধ্যে ওভার দ্য কাউন্টার (ওটিসি) বা ব্যবস্থাপত্রবিহীন ওষুধ কেনা যায়। ৩৯টি ওটিসি ওষুধের বেশির ভাগই দেশের আবহাওয়ার স্বাভাবিক তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় না। এর মধ্যে সাধারণ ওষুধ প্যারাসিটামল গোত্রের সেবন সবচেয়ে বেশি। জ্বর কিংবা হালকা ব্যথা মানেই প্যারাসিটামল। এ গোত্রের ওষুধের মধ্যে ট্যাবলেট, পাউডার, সিরাপ কিংবা সাপোজিটর দেশীয় দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে উৎপাদন ও বাজারজাত করে। বুক জ্বালাপোড়া বা গ্যাস্ট্রিকের জন্যও নানা গোত্রের ওষুধ রয়েছে। তবে এসব সাধারণ ওষুধও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। ওটিসির কোনো কোনো ওষুধ রাখতে হয় ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে আলোহীন, শুকনো ও ঠাণ্ডা স্থানে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর বলছে, দেশে অ্যালোপ্যাথিক, ইউনানি, আয়ুর্বেদিক, হোমিওপ্যাথিক এবং হার্বাল ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করছে ৬৯২টি প্রতিষ্ঠান। দেশে অ্যালোপ্যাথিকের ৩২ হাজার ৫৫০টি ওষুধ বাজারে রয়েছে। এসব ওষুধ প্রায় ৪০০ মডেল ফার্মেসি, ৩২ হাজার মডেল মেডিসিন শপ ও ১ লাখ ৩৮ হাজার ওষুধের দোকানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে। এর মধ্যে মডেল ফার্মেসিকে নির্দিষ্ট নীতিমালা মেনে কার্যক্রম চালাতে হয়।
বাজারের সব ওষুধের বাক্স, কার্টনের গায়ে সংরক্ষণের নির্দেশনা লেখা থাকে। একই সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নির্দেশনাও রয়েছে। এ নির্দেশনা ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের জন্য একইভাবে প্রযোজ্য। ভোক্তাদের জন্য ওষুধ সংরক্ষণে নির্দেশনা মেনে চলতেও ওষুধের মোড়কে সতর্কতামূলক নির্দেশনা দেয়া থাকে। তবে বাজার ঘুরে বেশির ভাগ দোকানে নির্দেশনা মানতে দেখা যায়নি। তাপমাত্রার বিষয়ে স্পর্শকাতর অনেক ওষুধই রোগীর জন্য স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসিউটিক্যাল ক্যামেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল মাজিদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের দেশে প্রয়োজনের তুলনা ওষুধের দোকান বেশি। একটি বাজারে সর্বোচ্চ দুটি ওষুধের দোকান থাকতে পারে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলেও একই স্থানে ডজনের ওপর দোকান থাকে। ওষুধের দোকান যেখানে সেখানে হতে পারে না এমন ধারণাই নীতিনির্ধারকদের নেই। তিনি বলছেন, দেশে মোট ১ হাজার ৪০০ জেনেরিকের ওষুধ রয়েছে। গ্রাম থেকে রাজধানী পর্যন্ত ৯০ শতাংশ দোকানে সঠিক তাপমাত্রা মানা হয় না।
ওষুধের কার্যকারিতার সঙ্গে তাপমাত্রার সম্পর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক। তিনি জানান, গুণাগুণ নষ্ট হওয়া ওষুধ সেবনে ভালো ফল পাওয়া যায় না। অনেক ক্ষেত্রে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
এ বিষয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা আজ থেকে পাঁচ বছর আগে মডেল ফার্মেসি ও মডেল মেডিসিন শপ করার উদ্যোগ নিয়েছি, তা এরই মধ্যে উপজেলা পর্যন্ত করা হয়েছে। বিষয়টি চলমান। এ বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। একদিনে এ কাজ করা সম্ভব নয়।