উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য উৎপাদন: ফসলের মৌসুমেও খাদ্যাভাবে গাইবান্ধার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী

গত দুই দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে অর্ধেকের বেশি। দূর করা যায়নি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। এখনো খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের ২১ শতাংশ মানুষ। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, বান্দরবান, কক্সবাজার ও জামালপুর—এ ছয় জেলায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি। এসব জেলার খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব

কৃষিনির্ভর গাইবান্ধায় স্থানীয় চাহিদার তুলনায় ধানের উৎপাদন বেশি। এর পরও বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে পর্যাপ্ত মানসম্মত খাদ্যের সংকটে পড়ে জেলার প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। মূলত ফসল রোপণ থেকে কাটার মৌসুমে জেলাটির নিম্ন আয়ের বাসিন্দারা প্রয়োজনীয় খাদ্য কিনতে পারছে না। ওই সময়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের এক-তৃতীয়াংশের দৈনিক প্রয়োজনীয় বৈচিত্র্যপূর্ণ খাবারের সংস্থান হয় না। বারবার বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে জেলার গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা প্রভাবিত হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের চর, উপকূল ও হাওর এলাকা বেশির ভাগ সময় দুর্যোগকবলিত হয়ে পড়ে। বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা ও নদীভাঙনের ফলে এসব এলাকা দুর্যোগপ্রবণ হয়ে ওঠে। এতে যোগাযোগ ব্যবস্থা, গ্রামীণ অবকাঠামো, গ্রামীণ স্বাস্থ্য অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, করতোয়া নদীর জেলা গাইবান্ধার ৯৮ শতাংশ পরিবারই কৃষি আয়ের ওপর নির্ভরশীল বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তর।

কৃষি বিভাগের তথ্যমতে, সাড়ে ২৪ লাখ জনসংখ্যার জেলাটিতে ৬ লাখ ১১ হাজার পরিবারের মধ্যে ৬ লাখ ১ হাজারটি কৃষিনির্ভর। ৯৮ শতাংশ পরিবার কৃষিভিত্তিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল হলেও ২০ শতাংশ ভূমিহীন। জেলায় জমির ৭৩ শতাংশ বা ১ লাখ ৫৭ হাজার ২৬৪ হেক্টর ফসলি জমি। জেলায় ফসলের চাহিদা চার লাখ টনের কিছু বেশি হলেও খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৬ লাখ ৯৫ হাজার ৭১ টন। এতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় তিন লাখ টন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্ত থাকছে।

গত তিন শতাব্দীতে জেলায় অন্তত সাতবার দীর্ঘস্থায়ী মারাত্মক খরা, পাঁচবার অনাবৃষ্টি ও সেচের অভাবে কৃষি চাষ ব্যাহত হয়। প্রচণ্ড দাবদাহে শস্য পুড়ে খাদ্যের অভাব দেখা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমানে বোরো ফসল ব্যাপকভাবে চাষাবাদ করার হলেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পর্যাপ্ত খাদ্যের সংকট পুরোপুরি যায়নি।

প্রকৃতিগত বিপর্যয় যেমন বারবার ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙন, দুর্বল মানবসম্পদ ও ভৌত সম্পদের অপর্যাপ্ততা গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)। ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময় নিয়ে দেশের সব জেলার খাদ্যনিরাপত্তার চিত্র বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছে, গুরুতর ও মাঝারি দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় অন্যতম গাইবান্ধা। এ জেলায় ১৫ শতাংশ বা পৌনে চার লাখ মানুষ গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব মানুষ বছরের চার মাস বা তার বেশি সময় এক বেলা খাবার নিয়ে সংকটে ভুগছে। আর ২৫ শতাংশ বা সাড়ে ছয় লাখ মানুষ মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা বছরের দু-চার মাস এক বেলা খাবারের অভাবে থাকে।

বন্যার পুনরাবৃত্তি ও নদীভাঙনপ্রবণ জেলাটিতে প্রতি বছরই মানুষের জীবিকা ও শস্য উৎপাদন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই গড়ে জেলার প্রায় ২০ থেকে ৪০ শতাংশ মানুষ বন্যা ও নদীভাঙনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে আইপিসি। জেলায় চাহিদার চেয়ে ধানের উৎপাদন বেশি হলেও ফসল রোপণ থেকে তা কেটে ঘরে তোলার সময় পর্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর পরিবারগুলোর খাদ্য ক্রয়ের সক্ষমতা থাকে না। ফলে তারা গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় পড়ে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর গাইবান্ধা সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর জেলাটি বন্যাকবলিত হয়ে পড়ায় সাত উপজেলার মধ্যে তিনটিতে আউশ, আমন বীজতলা, পাট, শাক-সবজি, তিল ও বাদামের শস্য খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলা তিনটি চরপ্রধান। মে মাস থেকে চলতি মাস পর্যন্ত বন্যায় সদর উপজেলারও কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাইবান্ধায় মোট ৪০৪ হেক্টর জমির ফসল বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

স্থানীয় চাহিদার তুলনায় গাইবান্ধায় ফসল উদ্বৃত্ত থাকে উল্লেখ করে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. বেলাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে জানান, ধান উৎপাদন বেশি হলেও ডাল ও মসলাজাতীয় ফসলে ঘাটতি রয়েছে। ধানের সঙ্গে সঙ্গে ভুট্টা ও গমের উৎপাদন ভালো হচ্ছে। তবে বিদেশ থেকে তেল আমদানি কম হওয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধিতে জোর দেয়া হয়েছে। বর্তমানে পতিত জমির পরিমাণ কমে এসেছে।

তিনি বলেন, বসতবাড়ির অনাবাদি পতিত জমিতে শাকসবজি চাষ করার প্রকল্প রয়েছে। প্রকল্পের অধীনে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এতে কৃষকরা আপত্কালে না খেয়ে থাকছেন না। বন্যার আগেই দুর্যোগের পূর্বাভাস দেয়া হয়। পেশা পরিবর্তন করার ফলে জেলায় কৃষি শ্রমিকের অভাব দেখা দিচ্ছে। কৃষির যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়।

অদক্ষ ও নিম্ন মূল্যের শ্রম, টেকসই আয়ের উৎস না থাকা, মাছ শিকার ও সনাতনী কৃষি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা ঝুঁকি বাড়িয়েছে উল্লেখ করে আইপিসি বলছে, কৃষিনির্ভর গাইবান্ধার ৬০ শতাংশেরও বেশি মানুষের জীবিকার উৎস টেকসই নয়। প্রতি পাঁচটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার ভূমিহীন। আর প্রতি ১০ পরিবারের চার পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। ফলে জেলার ৬০ শতাংশ শিশু ও ৭০ শতাংশ নারী পর্যাপ্ত বৈচিত্র্যময় খাবার পায় না।

কৃষি ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গাইবান্ধায় বছরে কয়েক দফায় বন্যা হয়। চরাঞ্চলগুলোয় নদীভাঙন হয়। এতে ফসলি জমি ও বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা যেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে না পড়ে তার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে পড়লেও তা কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতার ব্যবস্থা রাখতে হবে। বন্যা ঠেকানোর জন্য যথাযথ জায়গায় টেকসই বাঁধ দেয়া হয়। সাম্প্রতিক সময়ের বন্যা হয়েছে পানিপ্রবাহের জায়গায় বাঁধ দেয়ার কারণে। দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সমস্যাগ্রস্ত পরিবারগুলোর তালিকা করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের দক্ষ করে তুললে অনেকটাই সমস্যার সমাধান হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, বন্যায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাদের খাবার দেয়ার সক্ষমতা সরকারের থাকলেও সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি রয়েছে। এ কারণে দুর্গত মানুষের জন্য গুচ্ছগ্রামের চিন্তা করতে হবে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও আবাসনের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশে ২০৫০ সাল নাগাদ কোনো কৃষিজমিই আর অবশিষ্ট থাকবে না। তখন খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা আরো গুরুতর হবে। পুরো আমদানিনির্ভর হয়েও তা রোধ করা যাবে না। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণে অপুষ্টির সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সাধারণত নারী ও নারী শিশুরা পুষ্টির অভাবে পড়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিসিক শিল্পনগরীগুলোকে উন্নত করতে হবে। তাহলে কর্মসংস্থান তৈরি করা যাবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে সরকারের ভর্তুকি দিতে হবে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরিচালক (ক্রপস উইং) মো. জাহিদুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, হোম গার্ডেনিং প্রকল্পের মাধ্যমে আমরা প্রতি ইউনিয়নে ১০০টি বাড়িতে বাগানের বীজসহ বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করছি। পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন অঞ্চলের পরিবারগুলোর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দূর করা। পুষ্টির নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। শাকসবজি ও মাশরুম চাষের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এতে পরিবারগুলোর আয় বাড়বে। দারিদ্র্য দূরীকরণের পাশাপাশি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা কমে আসবে। চরাঞ্চলে ভুট্টা, চীনাবাদাম, মাষকলাই—এসব ফসল চাষে ঝুঁকি কম।

Source: Bonik Barta

Share the Post: