বান্দরবানের দুর্গম অঞ্চল: ভঙ্গুর যোগাযোগ ও পতিত জমি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণ

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের আয়তন প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গকিলোমিটার। জেলার মোট জমির মাত্র ১৭ শতাংশের কিছু বেশি অংশে বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষ হয়। মূলত অনুন্নত যোগাযোগ অবকাঠামো ও ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার কারণে জেলার ফসলি জমির বড় একটি অংশ সারা বছর চাষ করতে পারেন না স্থানীয় কৃষক। পতিত অবস্থায় থাকে জমির একটি বড় অংশ। আবার জুম চাষের শুরু থেকে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত অর্থাৎ জুন থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে দুর্গম অঞ্চলগুলোয় কৃষক পরিবারগুলোর জন্য বিকল্প কোনো খাদ্যের উৎস নেই। ফলে সে সময় খাদ্য সংকটে পড়ে এসব পরিবারের মানুষ। এ জেলার মোট জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখন রয়েছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকা, জমির সম্পূর্ণ ব্যবহার না হওয়াসহ নানা কারণে বছরের বড় একটি সময় জেলার দুর্গম এলাকার বাসিন্দারা বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের সংকটে পড়ে।

যেমন বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রী ইউনিয়নে যোগাযোগের একমাত্র বাহন নৌকা। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টি ইউনিয়নটির সবচেয়ে বড় সমস্যা। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুইশৈথুই মারমা বণিক বার্তাকে বলেন, ইউনিয়নটি সদর থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। রেমাক্রী ও তিন্দুতে মোবাইলের নেটওয়ার্ক পাওয়াও কঠিন। ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও টাকা থাকলেই কেবল থানচি সদর থেকে খাদ্যদ্রব্য কিনতে পারে স্থানীয় বাসিন্দারা।

সাধারণত অতিবৃষ্টি হলেও চলতি বছর অনাবৃষ্টির মুখে পড়তে হয়েছে বলে জানান মুইশৈথুই মারমা। তিনি বলেন, কয়েকদিন ধরে প্রচণ্ড গরম। বৃষ্টির দেখা নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে এবার ধান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। আর সেটি যদি হয় তাহলে আগামী বছর খাদ্য সংকটে পড়বেন স্থানীয় কৃষক। এমনিতেই বছরে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর জুমচাষীদের খাবার সংকট থাকে। আগামী ১৫ দিনেও বৃষ্টি না হলে সে সংকট আরো ঘনীভূত হবে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রুমা উপজেলার গ্যালেংগা ইউনিয়ন, থানচি উপজেলার তিন্দু ও রেমাক্রী ইউনিয়ন ও আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়ন ও রোয়াংছড়ি উপজেলায় প্রায় সব ইউনিয়নে বছরের কয়েক মাস খাদ্যের সংকট থাকে। মূলত দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় এসব এলাকার বাসিন্দারা পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। যেটুকু ফসলি জমি আছে সেগুলোও যথাসময়ে চাষ করা যায় না, অনেক জমিই পতিত থাকে। থানচি, রুমা ও আলীকদম উপজেলার দুর্গম অঞ্চলে দরিদ্র পরিবারের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। কৃষিনির্ভর এসব পরিবার জুমের ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত খাদ্যের তীব্র সংকটে ভোগে।

চলতি বছর অনাবৃষ্টি ফসলের ক্ষতি করলেও অতিবৃষ্টিও এসব এলাকার বাসিন্দাদের জন্য দুর্ভোগ বয়ে আনে। অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে নষ্ট হয় ফসল। পানি নিষ্কাশনের সরু পথগুলো ভরাট হয়ে যাওয়ায় জমি থেকে পানি সরতে পারে না। বৃষ্টির কারণে গত বছর গ্রীষ্মকালীন ও আগাম শীতকালীন সবজির ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানালেন স্থানীয় কৃষকরা। এর কারণে বছরের বড় একটা সময় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয় তাদের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেকোনো অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বের করে আনা যায়। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো করা না হলে পাহাড়ি অঞ্চলের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা দীর্ঘ সময়ের জন্য দূর করা যাবে না।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বান্দরবানে মোট ফসলি জমির পরিমাণ ৭৩ হাজার ৪৭৭ হেক্টর। এছাড়া পতিত জমির পরিমাণ প্রায় ৫১ হাজার হেক্টর। যদিও এ জমিগুলো স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে পতিত থাকে। এ জেলায় নানা জাতের ফল, ধান, চীনাবাদাম, আদা, হলুদ, তিল, তুলা, আনারস, কলা, লেবুসহ বিভিন্ন শাক-সবজি উত্পন্ন হয়। তবে প্রায়ই প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে এসব ফসল চাষে বিঘ্ন ঘটে, যা বিশেষত দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মুখে ফেলে দেয়।

২০১৮ সালে সর্বশেষ বন্যায় নাইক্ষ্যংছড়ি ছাড়া বাকি ছয় উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে সময় লামা ও আলীকদম উপজেলায় মাতামুহুরী নদীতে পানি বিপত্সীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। সাঙ্গু নদী ঘেরা থানচি, রুমা, রোয়াংছড়ি ও বান্দরবান সদর দুর্যোগের মধ্যে পড়ে। এর আগে ২০১৬ সালে আকস্মিক বন্যায়ও জেলার কৃষি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশনের (আইপিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে গুরুতর ও মাঝারি দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় অন্যতম বান্দরবান। জেলাটির ৩৫ শতাংশ মানুষ মধ্যম ও গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ বা প্রায় ৭২ হাজার মানুষ গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এসব মানুষ বছরের চার মাস বা তার বেশি সময় একবেলা পর্যাপ্ত খাদ্যের সংকটে পড়ে। আর ২০ শতাংশ বা ৯৬ হাজার মানুষের মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা রয়েছে। এসব মানুষের বছরের দুই থেকে চার মাস একবেলা পর্যাপ্ত খাবারের সংস্থান হয় না। বাকি ৩৫ শতাংশ বা দেড় লাখের বেশি বাসিন্দা মৃদু দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা থাকলেও ৩০ শতাংশ বা প্রায় দেড় লাখ বাসিন্দার কোনো খাদ্যের নিরাপত্তাহীনতা নেই।

আইপিসি বলছে, বান্দরবানের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ প্রচলিত কৃষির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তাদের আয়ের উৎস স্থিতিশীল নয়। অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকায় ৬০ শতাংশ নারী ও শিশুর পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করা যায়নি। ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশের সব জেলার খাদ্যনিরাপত্তার চিত্র বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি এসব তথ্য দিয়েছে। ইউএসএআইডির আর্থিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ সরকার এবং ৩১টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ আইপিসি ক্রনিক ফুড ইনসিকিউরিটি রিপোর্ট’ শিরোনামের আইপিসির গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মধ্যম ও গুরুতর মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আয়ের উৎস টেকসই না হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলেই দুর্গম পাহাড়ের মানুষ খাদ্য সংকটে পড়ে। আবার দুর্গম অঞ্চলগুলোতে কোনো কারণে সদর থেকে খাবার নিতে না পারলেও খাদ্য সংকট দেখা দেয়। বান্দরবানের কিছু এলাকা এতটাই দুর্গম যে পৌঁছতে দু-তিনদিন লেগে যায়।

বান্দরবান জেলার উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিশুক চাকমা বলেন, পতিত জমির কিছু অংশে ফলদ বাগান ও বনজ বাগান করার পরিকল্পনা রয়েছে। জেলার বেশির ভাগ পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে মানুষ জুম চাষ করে আবার কয়েক বছর ফেলে রাখে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা সেখানে ফল বাগান বা সেগুন বাগান করে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হলে ফল বাগান করেও তো কোনো লাভ হয় না। সে কারণে জেলায় পতিত জমিগুলোর জন্য বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। কৃষকদের উত্সাহ দেয়া হচ্ছে। প্রদর্শনীর আয়োজন করা হচ্ছে। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তা টেকসই হচ্ছে না।

এ অবস্থায় যোগাযোগ বাধা কীভাবে দূর করা যায় বা দুর্গম এলাকার বাসিন্দাদের জন্য বিকল্প আয় বা খাবারের উৎস সৃষ্টি করা যায় কিনা, সেদিকে মনোযোগী হতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

দীর্ঘদিন খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. মো. রুহুল আমিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার অনেক কারণ রয়েছে। চাষযোগ্য জমির বিশাল একটা অংশ চাষের আওতায় আসছে না। সেটা মালিকানার সমস্যা নাকি প্রযুক্তিগত ব্যবস্থার অভাবে তা নির্ণয় করা জরুরি। বিপণন ব্যবস্থায়ও সমস্যা থাকতে পারে। মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বাড়লেই তা সবার ভাগে যায় না। একটা অংশ থাকবেই যাদের আয় কম। জাতীয় আয়ের সঙ্গে তাদের আয়ের সামঞ্জস্য নেই। এ সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা পরিকল্পনামাফিক বাস্তবায়ন জরুরি।

এ বিষয়ে কৃষি সচিব মো. সায়েদুল ইসলাম বলেন, আমরা মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষকদের দারিদ্র্য কমিয়ে আনার জন্য কাজ করছি। তাদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন বান্দরবান প্রতিনিধি মংটিং মারমা)

Source: Bonik Barta

Share the Post: