কক্সবাজারে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে দুর্যোগ ও রোহিঙ্গা

গত দুই দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে অর্ধেকের বেশি। দূর করা যায়নি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা। এখনো খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে দেশের ২১ শতাংশ মানুষ। বিশেষ করে কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, গাইবান্ধা, বান্দরবান, কক্সবাজার ও জামালপুর— এ ছয় জেলায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা সবচেয়ে বেশি। এসব জেলার খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের পঞ্চম পর্ব

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের পর্যটন নগরী কক্সবাজার, যার অপরূপ সৌন্দর্য দেখতে প্রতি বছর ছুটে আসেন লাখ লাখ পর্যটক। দেশী-বিদেশী এসব পর্যটকই শক্তিশালী করে তুলেছেন জেলাটির অর্থনীতিকে। সেই সঙ্গে রয়েছে কৃষি ও সমুদ্রনির্ভর আয়। তবু জেলার শতভাগ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এখনো নগরীর এক-তৃতীয়াংশ বাসিন্দা দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে যুদ্ধ করে দিন পার করছেন। মূলত ঘূর্ণিঝড়, ঝড়, ভূমিধস ও পানিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধির কারণে প্রতি বছর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলার ১০-২০ শতাংশ পরিবার। সেই সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস জেলার দুর্যোগ ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাকে প্রভাবিত করেছে আরো বেশি।

স্থানীয়রা জানান, বিগত কয়েক বছরে কক্সবাজারের ভূগর্ভস্থ পানিতে লবণের পরিমাণ বেড়েছে। জোয়ারে লবণের পানি কৃষিজমিতে প্রবেশ করায় নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল। তাছাড়া বাঁকখালী ও মাতামুহুরী নদীর কোনো শাসন ব্যবস্থা নেই। ফলে লবণাক্ত পানি জেলা শহরসহ বিভিন্ন স্থানের জমিতে ঢুকে যাচ্ছে। তাতে চাষাবাদের জন্য সংকট তৈরি হচ্ছে পর্যাপ্ত মিঠা পানির। জেলা শহরের ভূগর্ভস্থ পানিতেও লবণের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবৈধভাবে পাহাড় কাটা। এতে পাহাড়ের ছোট নালা, ছড়া ও ঝরনাগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রতি বছর বারবার ঝড়, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগও কৃষিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

সেই সঙ্গে জলাবদ্ধতার সমস্যা তো রয়েছেই। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় জানিয়েছে, কক্সবাজারের খাল ও নদীগুলো বঙ্গোপসাগরে মিলিত হওয়ায় বৃষ্টির পানি নামতে পারে না। এতে বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হলে আউশ ধান বপনের সময় চাষাবাদ কঠিন হয়ে পড়ে। এ সময় জেলার প্রায় ৭০ হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকে। জেলায় মোট জমির ৩৪ শতাংশ চাষাবাদ হয়, যা ৮৫ হাজার ৫৭১ হেক্টর। এর মধ্যে বোরো মৌসুমে ১৫ হাজার হেক্টর সাময়িক পতিত জমি থাকে। আমন মৌসুমে দু-তিন হাজার হেক্টর পতিত জমি থাকে।

কৃষিকাজ ছাড়াও মত্স্য শিল্পেও সংযুক্ত রয়েছেন স্থানীয় অনেক বাসিন্দা। কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স ও সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, কক্সবাজারের একটি বড় অংশ মত্স্য শিল্পে জড়িত। সরকারিভাবে বছরে টানা তিন-চার মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে। সে সময় পরিবারগুলোকে যে চাল প্রণোদনা দেয়া হয় তা অপ্রতুল। ফলে তাদের খাবারের সংকটে থাকতে হয়। তাছাড়া জলাবদ্ধতা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি হয়। রামুতে প্রচুর আকস্মিক বন্যা হয়। তাতে দ্রব্যমূল্য যেমন বাড়ে তেমনি কৃষক প্রত্যাশিত ফলন ঘরে তুলতে পারেন না।

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার মতো পরিস্থিতি তৈরিতে রোহিঙ্গা সংকটও ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যও স্থানীয়দের অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এতে জেলায় সাবমার্সিবল পাম্পে পানি উঠছে না, কৃষকরা সেচের পানি পাচ্ছেন না। এমন পরিস্থিতিতে কক্সবাজার সদর, টেকনাফ, পেকুয়া, উখিয়া, কুতুবদিয়া, রামু এসব এলাকার মানুষ বেশি খাবার নিয়ে সংকটে ভুগছে।

সমুদ্র উপকূলবর্তী কক্সবাজারের প্রায় ৬০ শতাংশ মানুষের আয়ের উৎস স্থিতিশীল নয় বলে জানিয়েছে বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি)। ২০০৯-১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছর সময় নিয়ে দেশের সব জেলার খাদ্যনিরাপত্তার চিত্র বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলেছে, গুরুতর ও মাঝারি দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার অন্যতম জেলা কক্সবাজার। তারা বলছে, ১০-২০ শতাংশ পরিবার ঝড়, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধস, লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতি বছর। জেলাটিতে ৩৫ শতাংশ মানুষ মধ্যম ও গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। এর মধ্যে ১০ শতাংশ বা পৌনে তিন লাখ মানুষ গুরুতর দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা বছরের চার মাস বা তার বেশি সময় এক বেলা খাবারের সংকটে থাকে। আর ২৫ শতাংশ বা সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তারা বছরের দু-চার মাস এক বেলা খাবারের অভাবে থাকে।

২০১৭ সালে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সেখানকার রাখাইন রাজ্যের মুসলিম জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে শুরু করে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে ১০ লাখ রোহিঙ্গা। উখিয়া ও টেকনাফে পাহাড়ের গাছ ও ফসলি জমি ধ্বংস করে বসতি স্থাপন করে তারা। আইপিসি বলছে, ২০১৫ সালের তুলনায় পরবর্তী সময়ে শুধু রোহিঙ্গাদের কারণে জেলার মানুষের দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে ৫ শতাংশ। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হচ্ছেন নিম্ন আয়ের কৃষক, জেলে ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণে জেলায় প্রায় অর্ধেক নারী ও শিশু দৈনিক খাবারের ন্যূনতম বৈচিত্র্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জেলার অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষের জরুরি খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা শুধু শস্য উৎপাদনের ঘাটতি নয় বলে মন্তব্য করেছেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে গেছে। কক্সবাজারের ক্যাম্পে যারা আছে তারা মূলত স্থানীয়দের জীবিকার ওপর প্রভাব ফেলছে। খাবার থাকলেও যদি আয় না থাকে তাহলে তা কিনে গ্রহণের অবস্থা থাকে না। রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় মানুষের আয় কমেছে। শুধু উৎপাদনের সঙ্গে নয়, খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা খাদ্যের প্রাপ্যতার সঙ্গেও জড়িত। আমাদের খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। কক্সবাজারে বন ধ্বংস করার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়েছে। এ বিষয়গুলোকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

বারবার ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, নদীভাঙন, দুর্বল মানবসম্পদ ও ভৌত সম্পদের অপর্যাপ্ততা দেশে গুরুতর খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে আইপিসি। ইউএসএআইডির অর্থায়নে বাংলাদেশ সরকার এবং ৩১টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় ১০ বছরের পর্যবেক্ষণের ওই প্রতিবেদনে আইপিসি বলেছে, দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ মধ্যম ও গুরুতর মাত্রার খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যা মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (কক্সবাজার) ভারপ্রাপ্ত উপপরিচালক আশীষ রঞ্জন নাথ বলেন, আমরা ফসলের উচ্চফলনশীল জাত ফলানোর ওপর জোর দিচ্ছি। কুতুবদিয়া, মহেশখালী, টেকনাফসহ কয়েকটি জায়গায় ভূমিতে লবণাক্ততা রয়েছে। আমরা বিভিন্ন প্রণোদনাও দিচ্ছি যেন কৃষক এসব ধান চাষে উৎসাহিত হন। গভীর নলকূপের কারণে জেলায় অগভীর প্রায় সাত হাজার নলকূপে পানি পাওয়া নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা লবণাক্ত অঞ্চলগুলোয় কীভাবে লবণ সহনশীল ফসল উৎপাদন করা যায় সে উদ্যোগ নিচ্ছি। এরই মধ্যে ধানের কয়েকটি জাত চাষ হচ্ছে। সাময়িক লবণাক্ত পানি ঢুকলেও এসব ফসলের ক্ষতি হয় না। একটি প্রকল্পে কক্সবাজারের পাহাড়ি এলাকাগুলোয় কাজুবাদাম চাষের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তাছাড়া আমরা যেভাবে সেচের জন্য পানি ব্যবহার করছি তাতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পানি খরচ হচ্ছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: