জিন্নাতুল ইসলামের সাম্প্রতিক সময়ে স্তন ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে। রোগটি যেন ছড়িয়ে না পড়ে, তাই দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে সার্জারি করা হয় ষাটোর্ধ্ব এ বৃদ্ধার। তবে রেডিওথেরাপি প্রয়োজন হলে তাকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে (এনআইসিআরএইচ) রেফার করা হয়। কারণ মমেক হাসপাতালের সেই যন্ত্রটি আট বছর ধরে অকেজো। এদিকে ক্যান্সার চিকিৎসায় সরকারের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এনআইসিআরএইচ জিন্নাতুলের রেজিস্ট্রেশনেরই তারিখ নির্ধারণ করেছে আগামী বছরের জুনে। আর রেডিওথেরাপি পেতে কত সময় লাগতে পারে, তা অনুমানই করা যায়। একইভাবে রেডিওথেরাপির আশায় জরায়ু ক্যান্সার আক্রান্ত চল্লিশোর্ধ্ব বোন নাসিমা আক্তারকে নিয়ে রাজধানীর মহাখালীতে মাসখানেক ধরে বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান করছেন নূরে আলম। দিনের পর দিন ধরনা দিয়েও বোনের থেরাপির তারিখ পাচ্ছেন না। অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ হওয়ায় রোগীদের দেহে শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে মারণব্যাধি।
ক্যান্সারের চিকিৎসায় দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সরকারি এ হাসপাতালের মেঝেতে বসে প্রতিদিনই অপেক্ষা করেন শত শত সংকটাপন্ন রোগী। দিন শেষে ফিরে যেতে হয় নিরাশ হয়েই। কেউ আবার পৃথিবী থেকেই বিদায় নেন চিকিৎসা না পেয়ে। কারণ অনুসন্ধানে জানা যায়, এনআইসিআরএইচের তিন-চতুর্থাংশ যন্ত্রপাতিই অকেজো কিংবা নষ্ট। অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তো বছরের পর বছর অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। যেন দেখার কেউ নেই। তাই রোগীদের সঠিক সময়ে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। হাসপাতালটির সব স্তরেই যেন কর্তৃপক্ষের সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব স্পষ্ট।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা জানান, প্রকারভেদে ও রোগীর অবস্থা অনুযায়ী ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করেন চিকিৎসকরা। এর মধ্যে অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, বিকিরণ বা রেডিওথেরাপি সমান গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত অস্ত্রোপচারের পর কেমোথেরাপি দেয়া হয়। এরপর দেয়া হয় রেডিওথেরাপি। একজন রোগীকে কয়টি রেডিওথেরাপি দেয়া হবে, তা নির্ভর করে রোগের অবস্থা অনুযায়ী। তবে অন্তত ৮০ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে অন্যান্য চিকিৎসার পর রেডিওথেরাপি দিতে হয়। আর দেশে ক্যান্সারে আক্রান্তের ২৫ শতাংশই স্তন ক্যান্সারের রোগী। এদের সাধারণত কোবাল্ট যন্ত্র দিয়ে রেডিওথেরাপি দেয়া যায় না।
ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠার পর ১৯৯৫ সালে একটি কোবাল্ট যন্ত্র দিয়ে এনআইসিআরএইচ রেডিওথেরাপির কাজ শুরু করে। পরে আরো একটি কোবাল্ট যন্ত্র যুক্ত করা হয়। এরপর ২০০৮ ও ২০১০ সালে যুক্ত করা হয় চারটি লিনিয়ার এক্সেলারেটর মেশিন। এর মধ্যে মাত্র একটি লিনিয়ার এক্সেলারেটর সচল রয়েছে। একটি নষ্ট হয়েছে সম্প্রতি। বাকি দুটির আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। একইভাবে কোবাল্ট যন্ত্র দুটিও বাতিল করা হয়েছে গত বছরের শেষে। আর ব্র্যাকিথেরাপি দেয়ার জন্য যন্ত্র রয়েছে দুটি। এর মধ্যে একটি নষ্ট।
প্রতিষ্ঠানটির রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগ বলছে, লিনিয়ার এক্সেলারেটরের চেয়ে কোবাল্ট যন্ত্রে বেশি রোগীকে থেরাপি দেয়া যায়। সাধারণত যন্ত্র নতুন হলে কোবাল্টে ২০০ রোগীকে থেরাপি দেয়া সম্ভব। আর লিনিয়ার যন্ত্রে প্রায় ১০০। তবে যন্ত্রের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সক্ষমতা কমতে থাকে। তবে যন্ত্রগুলো কার্যকর থাকা অবস্থায় দিনে প্রায় এক হাজার রোগী রেডিওথেরাপি পেতেন। সেখানে এখন পাচ্ছেন কেবল ১০০ রোগী।
হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রোগ নির্ণয়ের জন্য দেড় যুগ আগে হাসপাতালে একটি ম্যাগনেটিত রেজোন্যান্স ইমেজিং (এমআরআই) যুক্ত করা হয়। তবে যন্ত্রটি চালু হওয়ার কয়েকদিন পরই অকেজো হয়ে পড়ে। এরপর নতুন করে কোনো এমআরআই যন্ত্র যুক্ত করা হয়নি। দুটি কম্পিউটেড টমোগ্রাফি স্ক্যান বা সিটি স্ক্যানের মধ্যেও একটি নষ্ট। একই সঙ্গে বিভিন্ন প্রকার ক্যান্সার শনাক্তের অনেক পরীক্ষাই এ হাসপাতালে করা যায় না। ফলে রোগীকে রোগ শনাক্তের জন্য অন্যান্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হচ্ছে। এতে গ্রাম থেকে চিকিৎসা নিতে আসা দরিদ্ররা পড়ছেন দালালদের খপ্পরে।
হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের অনেকের হাতেই সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে করা রোগ শনাক্তের প্রতিবেদন। তাদেরই একজন বরিশালের বাকেরগঞ্জের বৃদ্ধ আনিসুর রহমান। কোমরের হাড়ে ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে তার। তার চিকিৎসার জন্য মোট ১৭টি পরীক্ষার মধ্যে ১২টিই তিনি করিয়েছেন ঢাকার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে।
৫০০ শয্যার বিশেষায়িত এ হাসপাতালে একটি শয্যা পেতে অনেক রোগীকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। রোগীদের চিকিৎসা, ভর্তি ও অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের অবহেলা স্পষ্ট। মূল ভবনের লিফট নষ্ট হয়ে পড়ায় নতুন ভবনে উঠে দুই ভবনের সংযোগ সেতু দিয়ে চলাচল করতে হচ্ছে, যা বয়োজ্যেষ্ঠ ও রোগাক্রান্তদের ভোগান্তির কারণ। খরচ কম হওয়ায় সব সময়ই দরিদ্র রোগীদের ভিড় লেগে থাকে। তবে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছার অভাবে যন্ত্র নষ্ট হলেও তা দ্রুত মেরামত করা হয় না। এতে পুরনো রোগীরা সেবা না পেলেও ভিড় বাড়ে নতুন রোগীদের। আর কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যবস্থাপত্রে ‘তারিখ দেয়া যাচ্ছে না’ সিল মেরেই দায় এড়ান।
রেডিওথেরাপির সব যন্ত্র সচল থাকলে রোগীদের ভোগান্তি অনেকটাই কমে আসত বলে মনে করেন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন, হাসপাতালটির কোনো যন্ত্রই একসঙ্গে চালু রাখা যায়নি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন যন্ত্রের ঘাটতি ছিল, এখনো আছে। তাছাড়া যন্ত্রগুলো ক্রয় প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে চালুর পরও রয়েছে স্বচ্ছতার ঘাটতি। এসব পরিচালনার ক্ষেত্রে শক্ত জবাবদিহিতার মধ্যে আনা জরুরি। তাহলেই কেবল চিকিৎসাসেবায় গতি ত্বরান্বিত হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী উচ্চ আয়ের দেশে প্রতি লাখ মানুষের বিপরীতে অন্তত একটি রেডিওথেরাপির যন্ত্র থাকতে হবে। মধ্যম আয়ের দেশে প্রতি ১০ লাখে একটি ও নিম্ন আয়ের দেশের ক্ষেত্রে প্রতি ৫০ লাখে একটি। অথচ সাড়ে ১৬ কোটির বাংলাদেশে রয়েছে ৫০টিরও কম যন্ত্র।
বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির তথ্য বলছে, দেশে সরকারি পর্যায়ে ১৮টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সার বিভাগ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সার শনাক্তকরণ, অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপিসহ ক্যান্সার বিষয়ক কার্যক্রম চলছে। আর রেডিওথেরাপি ও ব্যাকিথেরাপি মেশিন রয়েছে ২৪টি। এর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ মেশিন অকার্যকর বা অকেজো রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে ১৭টি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছে। এগুলোতে ব্যাকিথেরাপি ও রেডিওথেরাপির জন্য ১৮ মেশিন রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে বেশির ভাগ মেশিনই কার্যকর রয়েছে। যদিও জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে ২০০-২৫০ রেডিওথেরাপি ও ব্যাকিথেরাপি মেশিন থাকা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসা বিলম্বিত হলে রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হয় বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মহিউদ্দিন ফারুক। তার মতে, ক্যান্সারের প্রকারভেদ ও রোগীর অবস্থা অনুযায়ী কাকে কয়টি থেরাপি দেয়া হবে, তা নির্ধারণ করা হয়। থেরাপি দিতে দেরি হলে রোগ আরো জটিল হতে শুরু করবে। রেডিও ও ব্যাকিথেরাপির যন্ত্রের কিছু ব্যবস্থাপনা রয়েছে। কেননা এর রেডিয়েশন যন্ত্র পরিচালনাকারীদেরও ক্ষতির কারণ হতে পারে। তবে ক্যান্সার হাসপাতালে রেডিওথেরাপির জন্য ছয়টি রেডিও প্রটেকটেড (সুরক্ষিত) কক্ষ রয়েছে। এখন অবকাঠামো ও লোকবল থাকার পরও যন্ত্রের অভাবে চিকিৎসা প্রলম্বিত হওয়া দুঃখজনক।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ ক্যান্সার। বছরে প্রতি ছয়টি মৃত্যুর একটিই হয় জটিল এ রোগের কারণে। ২০১৮ সালে এতে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা প্রাক্কলন করা হয়েছে প্রায় ৯৬ লাখ। দ্য গ্লোবক্যান সর্বশেষ ২০২০ সালের এক পরিসংখ্যানে বলেছে, বাংলাদেশে বছরে দেড় লাখ মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে মারা যাচ্ছেন ১ লাখ ৮ হাজার।
এনআইসিআরএইচের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৫-২০১৭ সালে হাসপাতালটিতে ৭৬ হাজার রোগী চিকিৎসা নিতে এসেছেন। এর মধ্যে ৩৫ হাজার ৩৬৯ জনের ক্যান্সার শনাক্ত হয়েছে, যারা এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন প্রধানত তাদের তথ্যই এ পরিসংখ্যানে তুলে আনা হয়েছে। যদিও এর বাইরে দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা তিন লাখের বেশি বলে ধারণা করছেন প্রতিষ্ঠানটির বিশেষজ্ঞরা।
রেডিওথেরাপির যন্ত্রসহ অন্যান্য যন্ত্র কেনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে জানিয়ে এনআইসিআরএইচের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. নিজামুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, নতুন করে মেশিন কেনার প্রক্রিয়া চলছে। কয়েক মাস আগে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এ প্রক্রিয়া পরবর্তী সময়ে বাতিল করা হয়। একেকটি মেশিনের দাম ন্যূনতম ২০ কোটি টাকা। তাই কিছুটা সময় এতে লেগে যাবে। তিনি আরো বলেন, সারা দেশের যেসব সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়, সেসব প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রগুলো নষ্ট হওয়ায় তারা রোগীদের এ হাসপাতালে (এনআইসিআরএইচ) পাঠান। এতে রোগীর চাপ সব সময়ই বেশি থাকে। তবে প্রায় দুই বছর ধরে মেশিনগুলো বেশির ভাগ সময়ই অকার্যকর ছিল। গত বছরের শেষে চারটি মেশিনকে অকেজো ঘোষণা করা হয়েছে। দুটির মধ্যে যেটি নষ্ট আছে তা মেরামত করা হবে। সাধারণত এসব মেশিন ১০ বছরের বেশি চালানো যায় না।
এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি উল্টো বিরক্তি প্রকাশ করেন। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারের সঙ্গে সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, এ বিষয়ে খোঁজখবর নেয়া হবে।