উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি শ্রমজীবীদের মধ্যে

পরিধি বাড়লেও আধুনিক নগরায়ণের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা না থাকায় নগরবাসীদের মধ্যে বাড়ছে দীর্ঘমেয়াদি রোগের প্রাদুর্ভাব। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগের ভার উঠছে শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর। নগর বাসিন্দার মধ্যে কায়িক শ্রমের মানুষের মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি পাওয়া গিয়েছে। এর ভুক্তভোগী এক-চতুর্থাংশ শ্রমজীবী। নারীদের চেয়ে পুরুষরা উচ্চরক্তচাপে বেশি ভুগছে।

সেভ দ্য চিলড্রেন বাংলাদেশের করা এক গবেষণার ফলাফলে এমনটি জানানো হয়। ‘হাইপারটেনশন অ্যান্ড ওবেসিটি লোড ইন বাংলাদেশ: হাউ লার্জ ইজ দ্য আইসবার্গ’ শিরোনামের গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে নগর এলাকার ২৩ শতাংশ মানুষের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া ১৪ শতাংশ মানুষ রয়েছেন উচ্চরক্তচাপের চরম ঝুঁকিতে। গবেষণায় অংশ নেয়া ৮ শতাংশের মধ্যে স্থূলতা রয়েছে। আর স্থূলতার ঝুঁকিতে রয়েছেন ২৮ শতাংশ মানুষ।

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি), সাউথ এশিয়া ফিল্ড এপিডেমিওলজি অ্যান্ড টেকনোলজি নেটওয়ার্কের (সেফটিনেট) সহায়তায় ‘স্ট্রেংদেনিং আরবান পাবলিক হেলথ সিস্টেম প্রজেক্ট’-এর অধীনে সেভ দ্য চিলড্রেন গবেষণাটি পরিচালনা করে। গবেষণায় নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও রংপুর সিটি করপোরেশন এলাকার প্রায় ৫০ হাজার মানুষের উচ্চরক্তচাপ ও স্থূলতা নির্ণয় ও ঝুঁকি যাচাই করা হয়।

গবেষণার ফলাফলে বলা হয়, বাংলাদেশের নগর এলাকায় বসবাসকারী প্রতি চারজন মানুষের মধ্যে একজনের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ পাওয়া গিয়েছে। অর্থাৎ ২৩ শতাংশ মানুষের মধ্যে রয়েছে এ দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা। সবচেয়ে বেশি উচ্চরক্তচাপ রয়েছে শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে। এসব জনগোষ্ঠীর ২৫ শতাংশই উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত। এরপর ব্যবসায়ী বা পেশাজীবীদের মধ্যে রয়েছে ২৪ শতাংশ। বেকার, শিক্ষার্থী ও গৃহিণীদের ২১ শতাংশ ও অন্য পেশাজীবীদের ১৭ শতাংশের মধ্যে রয়েছে উচ্চরক্তচাপ। আর ১৪ শতাংশ মানুষ ভবিষ্যতে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন।

দেশের ১২ সিটি করপোরেশনের ১১ জন স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ও ১৫ জন জনস্বাস্থ্য রোগতত্ত্ববিদ ওই চার সিটি করপোরেশনে এক বছরব্যাপী গবেষণা পরিচালনা করেন। রংপুর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান ইবনে তাজ বণিক বার্তাকে বলেন, শ্রমজীবীদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ বেশি কেন তার কারণ আমরা খুঁজে দেখিনি। তবে আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, তামাকের সঙ্গে উচ্চরক্তচাপ জড়িত। রংপুর সিটি করপোরেশনে উচ্চরক্তচাপ বেশি হওয়ার কারণ হলো, এ অঞ্চলের শ্রমজীবীদের অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে তামাকের সঙ্গে জড়িত। বিড়ি বানানো থেকে শুরু করে, তামাক আবাদ করা, মজুদ করা, বাড়িতে শুকাতে দেয়া, ঘরে মজুদ করা তাদের আয়ের উৎস। এখনো স্থানীয়দের জর্দা ও পানের মাধ্যমে আতিথেয়তার প্রচলন রয়েছে।

উচ্চরক্তচাপের প্রকোপ নারীদের চেয়ে পুরুষদের ২ শতাংশ বেশি। শহরের ২৪ শতাংশ পুরুষের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ রয়েছে। এতে বলা হয়, গবেষণায় খাবারে অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, উচ্চরক্তচাপের পারিবারিক ইতিহাস ও সংযোগ ইত্যাদিকে উচ্চরক্তচাপের কারণ হিসেবে দেখা গিয়েছে। ৩০ শতাংশ ভুক্তভোগীর পারিবারিক ইতিহাসে উচ্চরক্তচাপ পাওয়া গিয়েছে। আর ১৯ শতাংশের পরিবারের এ রোগের কোনো ইতিহাস নেই। শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে ৮ শতাংশ মানুষ স্থূলতায় ভুগছেন। আর ২৮ শতাংশ মানুষ রয়েছেন এর ঝুঁকিতে। পুরুষের চেয়ে নারীদের মধ্যে স্থূলতা বেশি। পুরুষদের ৭ শতাংশের মধ্যে স্থূলতা থাকলেও নারীদের মধ্যে এ প্রবণতা ১০ শতাংশ।

শ্রমজীবীদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা কেমন তার জন্য আগে গবেষণা হয়নি বলে জানিয়েছেন সেভ দ্য চিলড্রেনের হেলথ অ্যান্ড নিউট্রিশন সেক্টরের পরিচালক লিমা রহমান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, শ্রমজীবীদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রবণতা নানা কারণে বেশি হতে পারে। তবে তাদের মধ্যে এর প্রবণতা জানার জন্য আগে এমন গবেষণা দেখা যায়নি।

নগরায়ণের ফলে পরিবর্তিত জীবনযাত্রা উচ্চরক্তচাপে ভোগার জন্য দায়ী। উচ্চরক্তচাপ ও স্থূলতা বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে দেখা হচ্ছে। উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে মৃত্যুর কারণ হতে পারে। উচ্চরক্তচাপ মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বা রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হওয়া, করোনারি ধমনী রোগ, হার্ট ফেইলিওর, অ্যাট্রিয়াল ফাইব্রিলেশন ও পেরিফেরাল ভাস্কুলার রোগের মতো মারাত্মক অবস্থার বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার বাইরে থাকলে উচ্চরক্তচাপ, কিডনি জটিলতা, স্মৃতিভ্রংশ, মস্তিষ্কের জ্ঞানের প্রতিবন্ধকতা, চোখের ক্ষতি ও বৃক্বের বিকলতারও সৃষ্টি করতে পারে। উচ্চরক্তচাপকে অসংক্রামক রোগের (এনসিডি) অন্যান্য ঝুঁকির কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় যেমন শরীরের ওজন বৃদ্ধি, ডিসলিপিডেমিয়া, গ্লুকোজ অসহিষ্ণুতা। বাংলাদেশে বর্তমানে উচ্চরক্তচাপসহ যেকোনো অসংক্রামক দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি হিসেবে কাজ করছে। বেশি লবণ গ্রহণ, অতিরিক্ত মেদ, কাজের চাপ, ধূমপান, মদ্যপান, পরিবারের আকার, অতিরিক্ত আওয়াজ ও ঘিঞ্জি পরিবেশে থাকা। উচ্চমাত্রার লবণের ব্যবহারের কারণে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি সর্বোচ্চ। আর উচ্চরক্তচাপে ভুক্তভোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব বেশি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, উচ্চরক্তচাপ রক্তনালিগুলোর ওপর ক্রমাগতভাবে চাপ বাড়ায়। হূিপণ্ডের মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত প্রবাহিত হয়। এতে উচ্চরক্তচাপ রক্তনালিতে বাধা সৃষ্টি করে। এটি হূিপণ্ড, মস্তিষ্ক, কিডনি ও অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়ায়, যা অকালমৃত্যুর কারণ। বিশ্বে প্রতি চারজন পুরুষের একজন ও প্রতি পাঁচজন নারীর একজন এমন ঝুঁকিতে রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুই-তৃতীয়াংশ উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে দেখা গিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ধূমপান, তামাক ও অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ শ্রমজীবীদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ বৃদ্ধি করছে। ধূমপানের ফলে রক্তনালি চিকন হয়ে যায়, রক্তনালিতে চর্বি জমে গিয়ে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে ফেলে। একই সঙ্গে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা শ্রমজীবীদের মধ্যে দেখা যায় না। সচেতনতার অভাব হোক বা অর্থের সংকটে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা তারা করছেন না। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে শুরুতেই রোগকে শনাক্ত করে প্রতিরোধে ব্যবস্থা করা যায়। উচ্চরক্তচাপ বংশগত অসুস্থতার একটি হলো অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ।

Source: Bonik Barta

Share the Post: