জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল: ফিল্ম ও প্রতিবেদন নিয়েই বেশি ভোগান্তি রোগীদের

দেশে বক্ষব্যাধি চিকিৎসায় সর্বোচ্চ বিশেষায়িত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রাজধানীর মহাখালীর ৬৭০ শয্যার জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। বুকের বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসা মেলে এখানে। আর এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের উপসর্গভেদে রোগ নির্ণয়ে ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি অ্যান্ড হেমাটোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, সেরোলজি ও ইমিউনোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, হিস্টোপ্যাথলজি, স্পাইরোমেট্রি ব্রঙ্কোসকপি ইবাস, রেসপিরেটরি-স্লিপ ল্যাব, রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং এবং রক্ত পরিসঞ্চালনের অন্তত ৮০টি পরীক্ষার কথা বলা হয়। যদিও যন্ত্রের অভাব কিংবা অকেজো এবং রি এজেন্ট সংকটের কারণে এসব পরীক্ষার অনেকগুলোই করাতে হয় বাইরে থেকে। আবার যেগুলো করানো সম্ভব সেগুলোর ক্ষেত্রেও মানা হয় না পরিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি। বিশেষ করে রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের পরীক্ষায় পরিপূর্ণ পদ্ধতি না মানার অভিযোগ। হাসপাতালের সেবাগ্রহীতাদের জন্য প্রদর্শিত তথ্য অনুযায়ী, বিভাগটি ১১ ধরনের রঞ্জন রশ্মি বা এক্স-রে, পাঁচ ধরনের কম্পিউটেড টমোগ্রাফি (সিটি স্ক্যান) ও ছয় ধরনের আল্ট্রাসনোগ্রাম করে।

বুকের ব্যথা নিয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে চিকিৎসা নিতে আসেন চল্লিশোর্ধ্ব নজরুল ইসলাম। বহির্বিভাগে চিকিৎসকের পরামর্শে দুদিন আগে এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান করিয়েছিলেন। তবে ফিল্ম পেলেও পাননি রেডিওলজিস্টের কোনো প্রতিবেদন। পরীক্ষার সেই ফিল্ম চিকিৎসক দেখাতে বৃহস্পতিবার দুপুরের দিকে হাসপাতালের বহির্বিভাগে এসেছিলেন নজরুল। তবে প্রতিবেদন কেন দেয়া হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, রেডিওলজি বিভাগ থেকে আমাকে শুধু ফিল্মই দেয়া হয়েছে।

রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, পরীক্ষা করাতে আসা রোগীদের বেশ ভিড়। বিশেষ করে এক্স-রে, সিটি স্ক্যান ও আল্ট্রাসনোগ্রাম করাতে আসা রোগীদের সারিই সবচেয়ে বড়। এক্স-রে ও সিটি স্ক্যান করার পর রোগীদের হাতে কেবল ফিল্ম ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে সিটি স্ক্যান কক্ষে কর্মরত টেকনোলজিস্টরা বলেন, রেডিওলজির বিভাগীয় প্রধান অসুস্থ। তাই অন্তত আগামী ১৫ দিন পরীক্ষার রিপোর্ট দেয়া সম্ভব হবে না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের দুই চিকিৎসক জানান, সিটি স্ক্যান কিংবা এক্স-রে করার পর কোনো কোনো সময় কেবল প্রতিবেদন দেয়া হয় রোগীদের। রেডিওলজিস্টের লেখা সেই প্রতিবেদন দেখেই রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপত্র লিখতে হয় চিকিৎসককে। সরকারিভাবে পাওয়া ফিল্ম সরবরাহের সংকট হলেই মূলত এমনটা হয়ে থাকে। আবার কখনো রোগীরা ফিল্ম পেলেও মেলে না পরীক্ষার প্রতিবেদন। তখন কেবল ফিল্ম দেখেই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে রোগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

রেডিওলজির বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ফিল্ম ও রেডিওলজিস্টের প্রতিবেদন সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. নজরুল ইসলাম। তার মতে, ফিল্ম দেখে রেডিওলজির চিকিৎসক প্রতিবেদন লিখে থাকেন। নিখুঁতভাবে এসব ফিল্ম পর্যবেক্ষণ করতে হয়। এরপর যে চিকিৎসক রোগীকে পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি ফিল্ম ও প্রতিবেদন দেখে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেন। অনেক সময় ফিল্মের কোনো সূক্ষ্ম বিষয় রেডিওলজিস্টের চোখ এড়িয়ে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে প্রতিবেদনের সঙ্গে ফিল্ম মিলিয়ে দেখে ব্যবস্থাপত্র লেখেন চিকিৎসক। আবার ফিল্ম বা প্রতিবেদনে কোনো সূক্ষ্ম বিষয় বাদ পড়লে রেডিওলজি বিশেষজ্ঞ বা পরামর্শদানকারী চিকিৎসকের মধ্যে কারো না কারো চোখে তা ধরা পড়বে। যেকোনো একটির ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেয়া গেলেও রেডিওলজির বিভিন্ন পরীক্ষায় ফিল্ম ও প্রতিবেদন পরিপূরক হিসেবে কাজ করে।

বক্ষব্যাধি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, ফিল্ম ছাড়া কেবল প্রতিবেদন দেয়া হয়নি কখনো। তবে বিনামূল্যে যেসব নিরীক্ষা করা হয়েছে, সেসব পরীক্ষার ক্ষেত্রে ফিল্ম নষ্ট করা হয় না। হাসপাতালের নিজস্ব কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও পরীক্ষা শেষে কেবল একটি কাগজে লিখে দেয়া হয়। এ সেবা বিনামূল্যের হওয়ায় সরকারি ফিল্ম খরচ করা হয় না। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. খায়রুল আনাম এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, বিভাগীয় প্রধান করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় সিটি স্ক্যানের প্রতিবেদন দেয়া হচ্ছে না। তবে ফিল্ম ছাড়া শুধু প্রতিবেদন দেয়ার ঘটনা কখনো ঘটেনি। বিভাগীয় প্রধান অসুস্থ থাকলেও বিভাগের অন্য চিকিৎসকরা কেন প্রতিবেদন লিখছেন না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি সম্প্রতি পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছি। তাই ওই বিভাগে কতজন চিকিৎসক রয়েছেন, তা এ মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল সূত্রে অবশ্য জানা যায়, রেডিওলজির একজন অধ্যাপক অবসর নিয়েছেন, একজন সহযোগী অধ্যাপক বদলি হওয়ার পর বর্তমানে বিভাগে চারজন চিকিৎসক রয়েছেন। এর মধ্যে বিভাগীয় প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. সাবিনা আখতার করোনায় আক্রান্ত হয়ে ছুটিতে আছেন। বিভাগীয় চিকিৎসক অসুস্থ হওয়ায় বাকি তিন চিকিৎসকও প্রতিবেদন লিখছেন না।

ইনস্টিটিউটের পরিচালক পদ থেকে চলতি বছরের মাঝামাঝিতে অবসর নিয়েছেন অধ্যাপক ডা. সাইদুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, চিকিৎসকের সংকট হাসপাতালটিতে রয়েছে। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা থাকার পরও সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করেন চিকিৎসকরা। তবে রেডিওলজির পরীক্ষা শুধু ফিল্ম বা প্রতিবেদন পরিপূর্ণ পদ্ধতি নয়। বিভাগীয় প্রধান অসুস্থ বা ছুটিতে থাকলে অবশ্যই বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে। তবে সব প্রতিবেদন বিভাগীয় প্রধান লেখেন না। বিভাগের অন্য চিকিৎসকরাও প্রতিবেদন তৈরি করে থাকেন। বিভাগীয় প্রধান না থাকার কারণে তা সমন্বয় করা উচিত ছিল।

হাসপাতালটিতে রোগী ভোগান্তি, রোগীর কাছ থেকে কর্মচারীদের বাড়তি অর্থ আদায় ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীদের ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগও রয়েছে। বছর দুয়েক আগেও এমন অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় অভিযান চালিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। কয়েকজনের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছিল।

রোগ নিরীক্ষার বিভিন্ন যন্ত্র নষ্ট বা অকেজো এবং রি এজেন্ট না থাকার ঘটনাও ঘটছে বছরে বেশ কয়েকবার। থেমে থেকে নষ্ট হচ্ছে সিটি স্ক্যান মেশিন, এক্স-রেসহ বিভিন্ন যন্ত্র। বর্তমানে হাসপাতালটিতে জিন এক্সপার্ট কিটেরও সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে জিন এক্সপার্টে কোনো ধরনের পরীক্ষা হচ্ছে না। তবে এটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের নয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একটি কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষার ফিল্ম বা প্রতিবেদন দুটি অনেক ক্ষেত্রেই না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়টি পরিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি নয়। অথচ খুব কম সময়েই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষা শেষে প্রতিবেদন দিতে পারে। সরকারি হাসপাতালের এসব চিকিৎসকই কিন্তু বেসরকারিতে কাজ করেন। সরকারি হাসপাতালে সম্পদ ও লোকবলের অপর্যাপ্ততা থাকলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অনেক ভালো সেবা দেয়া সম্ভব। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে রোগীরা যতটুকু সেবা পাচ্ছেন তার চেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন বেশি। উপজেলা হাসপাতাল থেকে টারশিয়ারি পর্যায়ের হাসপাতালে এমন অবস্থা বিদ্যমান। আর সরকারি হাসপাতালে যন্ত্র নষ্ট হয়ে পড়ে থাকা ও ফিল্ম দিলে প্রতিবেদন না দেয়া বা প্রতিবেদন দিলে ফিল্ম না দেয়ার ঘটনা ঘটছে দায়িত্বশীলদের সদিচ্ছার অভাবে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: