বিশ্বে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। গত দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যগত অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে। সংক্রামক রোগ থেকে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এতে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। ফলে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে গত এক দশকে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির চাহিদা বেড়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতের পরিসর বেড়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। যদিও চাহিদার ৯২ শতাংশ সরঞ্জাম আমদানি করা হচ্ছে। আর স্থানীয় চাহিদার পরিমাণও বেড়েছে। গত পাঁচ অর্থবছরে স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা সরঞ্জামের উৎপাদন বেড়েছে ২১০ শতাংশ। বাজারে দেশীয় মেডিকেল সরঞ্জাম ধীরে ধীরে জায়গা করে নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে ২০২৫ সালে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজারের আকার দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা উল্লেখ করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) বলছে, জনসংখ্যার আয় ও ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের চাহিদা আরো বাড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে বিডা ‘মেডিকেল ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড ডিভাইসেস ইন্ডাস্ট্রি ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের এক প্রকাশনায় দেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজারের আকারের চিত্র তুলে ধরা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে প্রাপ্ত তথ্য সংকলন করে বিডা।
বিডা বলছে, বাংলাদেশে বর্তমানে চার হাজারের বেশি চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৮ শতাংশ দেশীয় প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করে। দেশে স্থানীয়ভাবে ইনজেকশনের সিরিঞ্জ, রক্তের ব্যাগ, রক্ত সঞ্চালন সেট, ক্যানুলা, রক্ত সংগ্রহের টিউব, হাসপাতালের শয্যা, আইসিইউ শয্যাসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম উৎপাদন করা হয়। দেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজার ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছিল ২৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্যের বাজার ছিল ১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৩২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে দেশীয় ছিল ৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৩৬৯ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ছিল ৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের সরঞ্জামের বাজার ছিল ৫৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের বাজারের আকার দাঁড়াবে ৮২২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
২০১৯ সালে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যসেবায় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ ব্যয় করে। এর মধ্যে সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার জন্য শতকরা ৭৩ শতাংশ ব্যয় রোগীকে নিজের পকেট থেকে করতে হয়। ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এসে স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য মাথাপিছু ব্যয় ৯ ডলার থেকে দাঁড়িয়েছিল ৪৬ মার্কিন ডলারে। দেশে চিকিৎসা সরঞ্জামের আমদানির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। যদিও বৈশ্বিকভাবে এ হার ৪ থেকে ৬ শতাংশ বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের বিকাশ হতে শুরু করে। বর্তমানে চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরির স্থানীয় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান রয়েছে অন্তত ১৫টি। এসব প্রতিষ্ঠান একশর বেশি সরঞ্জাম তৈরি করছে। সার্জিক্যাল ও ডায়াগনস্টিকের যন্ত্রপাতিও রয়েছে। তবে দেশে উৎপাদিত যন্ত্রাংশের দাম ও আমদানীকৃত যন্ত্রের দামের মধ্যে তারতম্য রয়েছে। প্রযুক্তি ও গবেষণাগত সহায়তা পেলে দেশের মধ্যে এ খাতের বিকাশ দ্রুত হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ম্যারেলিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, জিকা, ফাইলেরিয়া, যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া, করেলা, হেপাটাইটিস এ, টাইফয়েডসহ বিভিন্ন ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়াজনিক সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব কমেছে। অন্যদিকে ২০০০ সালের পর থেকে অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়েছে। এর মধ্যে হূদরোগ, স্ট্রোক, শ্বসনতন্ত্রের রোগ, ক্যান্সার, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর হারও বেড়েছে। বর্তমানে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৬৭ শতাংশই অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বেড়েছে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান।
বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মাইনুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন শুরু হলেও তার পরিসর অল্প। মানসম্মত সরঞ্জাম তৈরিতে আরো সময় লাগবে। এখন বিশ্বের অনেক দেশে সরঞ্জাম তৈরি হচ্ছে না। এমআরআই বা অন্য অনেক রোগ নির্ণয় যন্ত্র বা অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে, যা এক দেশ থেকে পরিপূর্ণভাবে আনা যায় না। যন্ত্রের এক অংশ এক দেশ থেকে, অন্য অংশ আবার অন্য দেশ থেকে আনতে হয়।
স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে প্রাতিষ্ঠানিক পরিসর বেড়েছে। হিসাব অনুযায়ী, দেশে সরকারিভাবে কমিউনিটি ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে সাড়ে ১৬ হাজার। এছাড়া প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান রয়েছে আড়াই হাজারের বেশি। আর বেসরকারি পর্যায়ে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ক্লিনিক, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে বারো হাজারের বেশি। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৪টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৪৯ হাজারের কিছু বেশি।
দেশীয় প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের সরঞ্জামের দাম আমদানীকৃত সরঞ্জামের চেয়ে বেশি উল্লেখ করেন বাংলাদেশ মেডিকেল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যান্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলারস অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মো. আতিকুর রহমান। তিনি বলেন, দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সরঞ্জাম এনে তা জোড়া লাগিয়ে বাজারে দেয়। নিজেরা উৎপাদন বা তৈরি খুব কমই করে। স্থানীয় সরঞ্জামের মান পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করা হচ্ছে না, আবার দামও বেশি। আমরা চাই দেশীয় পণ্যের বাজার বাড়ুক। তবে মান ভালো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দামও আমদানির চেয়ে কম বা সমান হতে হবে।
স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত সরঞ্জামের মান আন্তর্জাতিক মানের দাবি করছেন এসব প্রতিষ্ঠানসংশ্লিষ্টরা। জেএমআই সিরিঞ্জ অ্যান্ড মেডিকেল ডিভাইসের কোম্পানি সচিব মোহাম্মদ তারেক হোসেন খান বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউএইচও) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গাইডলাইন মেনে এবং বাংলাদেশে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদনে সরঞ্জাম উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়। এখানে মানের সঙ্গে আপস করা যায় না। আর দাম খুব বেশি নয়। প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যূনতম লাভে সরঞ্জাম বাজারে ছাড়ে।
চিকিৎসা সরঞ্জাম আমদানি, রফতানি ও উৎপাদনের বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে দেখভাল করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। সরকারের এ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বলছে, দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠান এখনো চিকিৎসার হাই-টেক ডিভাইস বা সরঞ্জাম উৎপাদন করা শুরু করেনি। এসব ক্ষেত্রে দেশে উৎপাদনে দাম বেশি পড়বে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সরঞ্জামের দাম আমদানি মূল্যের কাছাকাছি না হলে তাতে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে উৎপাদনের জন্য উৎসাহিত করা কঠিন। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করার ক্ষেত্রে আগ্রহী দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহ দেয়া হয়। সম্প্রতি আরো ছয়টি চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারক কারখানার প্রকল্প অনুমোদনের প্রস্তাব এসেছে। তাদের সক্ষমতা যাচাই করা হচ্ছে।
অধিদপ্তরের পরিচালক ও মুখপাত্র মো. আইয়ুব হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, সরঞ্জাম মানসম্মত না হলে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেয় না। কেউ মানহীন কোনো সরঞ্জাম আমদানি করতে পারবে না। কেউ মানহীন সরঞ্জাম উৎপাদন করলে সহজেই তা ধরা পড়বে। বেশ কয়েক বছর চিকিৎসার যন্ত্রপাতি বা সরঞ্জাম আমদানি ও উৎপাদন আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এর পরিসর অনেক বড়। আমি যতটুকু ধারণা করতে পারি যে রেজিস্ট্রেশনের সংখ্যা বেড়েছে। ভোক্তার চাহিদা পূরণ করাটাই আমাদের মূল কাজ, জনস্বার্থে আমরা কাজ করি। কেউ যদি জরুরি সরঞ্জাম আনতে চায় যা আমাদের দেশে উৎপাদন হয় না অথবা রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াটা সময়সাপেক্ষ সে ক্ষেত্রে আমরা অনাপত্তিপত্র দিয়ে থাকি।