দেশের বাজারে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেন নিত্য ঘটনা। আগের বছর একটি পরিবারের জন্য যে টাকায় বাজার হতো পরের বছর তার দ্বিগুণ দিয়েও হিমশিম খেতে হয়। নানা কারণেই গত এক দশকে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানো হয়েছে ১০০ শতাংশ। বেড়েছে অন্যান্য চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীদেরও আয়। তবে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগীদের প্রতিদিন দেয়া খাবারের বরাদ্দ বাড়ানো হয়নি তেমন। এক দশক পর এসে কেবল ৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। যদিও দ্রব্যমূল্য ও আনুষঙ্গিক খরচকে বিবেচনায় নিয়ে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি প্রতি রোগীর দৈনিক খাবারে ১৪০ শতাংশ বরাদ্দ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছিল। অর্থ বিভাগ অবশ্য সংখ্যাটির ‘১’ কেটে দিয়ে বাড়িয়েছে মাত্র ৪০ শতাংশ।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ পরিচালিত দেশের সব সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নন-কভিড রোগীদের দৈনিক খাবারের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রত্যেক রোগী দৈনিক ১২৫ টাকার পরিবর্তে সরকারের পক্ষ থেকে ১৭৫ টাকার খাবার পাচ্ছে। অর্থ বিভাগ গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিষয়টি অনুমোদন দিয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ সেটি গত ১০ অক্টোবর সারা দেশে বাস্তবায়ন করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সর্বশেষ ২০১৩ সালে খাবারের বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছিল। ওই সময় সাধারণ স্কেলের ডায়েটের দৈনিক বরাদ্দ ৫০ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ১২৫ টাকা। তবে সেখান থেকে আবার ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কেটে দেয়া হতো মাত্র ১০৬ টাকা। এর আগে ২০০৯ সালে রোগীপ্রতি বরাদ্দ ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা করা হয়। বর্তমানে ১৭৫ টাকা থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাদ দিলে থাকে ১৪৮ টাকা ৭৫ পয়সা। অর্থাৎ রোগীরা এ টাকায় দৈনিক তিনবেলা খাবার পাবে।
দেশের সরকারি হাসপাতালে রোগীদের সকালের খাবারে দেয়ার কথা ১৫০ গ্রাম পাউরুটি, চার ইঞ্চির একটি কলা, ২০ গ্রাম চিনি ও একটি ডিম। কলা না পেলে সেক্ষেত্রে অন্য কোনো ফল ও জেলি দেয়ার কথাও বলছেন একটি সরকারি হাসপাতালের পরিচালক। দুপুর ও রাতের খাবারে প্রতি বেলায় মাছ বা মাংস দেয়ার কথা রয়েছে। তবে এক কেজির রুই বা কাতল মাছ থেকে পিসের আকার হতে হবে ১৪০ গ্রামের। ৩৪০ গ্রাম মুরগির মাংস, ৩৪০ গ্রাম চাল। এছাড়া মসুর ডাল ও সবজি দেয়ার কথা বলা হয়েছে নির্দিষ্ট পরিমাণে। যদিও সরকার নির্দেশিত পরিমাণ খাবার দেয়া হয় না বলে অভিযোগ।
পুষ্টিবিদদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী একটি আদর্শ খাদ্যতালিকা হওয়া জরুরি বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিন। তাদের মতে, রোগীর স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে আদর্শ খাদ্যতালিকার বিকল্প নেই। আর স্বাস্থ্যগত দিক বিবেচনায় রেখে রোগীর পছন্দ অনুযায়ী খাবার প্রস্তুত করা হাসপাতালের দায়িত্ব। তবে দেশের সরকারি হাসপাতালে পুষ্টিবিদদের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী খাবার দেয়া হয় না বলে রোগীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ। যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহত্তম হাসপাতাল ট্রাস্ট ইস্ট কেন্ট হসপিটাল ইউনিভার্সিটির এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের মতে, রোগীদের খাবারে পুষ্টির যথাযথ সমন্বয় থাকা জরুরি। এক্ষেত্রে সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবার ছাড়াও রোগীকে দিতে হবে ফলের রস, দই, তাজা ফল, চা, কফি, চকোলেট ও বিস্কুট।
সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী হাসপাতালগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় খাবারের ব্যবস্থা করে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, প্রতি বছর দরপত্রের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারকে দিয়ে খাবারের জোগান দেয়। অঞ্চলভেদে দ্রব্যমূল্যের তারতম্য রয়েছে। ফলে সব হাসপাতালের দরপত্র এক হয় না। আবার শয্যার বাইরেও যেসব রোগী থাকে তাদের জন্যও খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়। সেই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। ‘সরকারি হাসপাতাল: এক দশক ধরে রোগীর তিনবেলা খাবারে বরাদ্দ ১০৬ টাকা’ শিরোনামে গত ২২ আগস্ট সংবাদ প্রকাশ করে বণিক বার্তা। এরপর বিষয়টি আমলে নেয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। পরবর্তী সময়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে রোগীদের খাবারে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। নির্ধারিত ১২৫ টাকা থেকে ১৪০ শতাংশ বাড়িয়ে ৩০০ টাকা বরাদ্দের আবেদন করা হয়। অর্থ বিভাগ সেখানে বরাদ্দ বাড়িয়েছে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ টাকা।
রাজধানীর দুটি সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘুরে ও ঢাকার বাইরে বিভাগীয় একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে টাকা বাড়ানো হয়েছে তাতে খাবারের পরিমাণ বাড়ানো কঠিন। শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. এইচএম সাইফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতি বছর দরপত্রের মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে খাবারের দায়িত্ব দেয়া হয়। বরাদ্দ ঠিক রেখে দরপত্র আহ্বান করা হয়। তবে সব অঞ্চলে চাল, মাছ বা অন্যান্য দ্রব্যের দাম এক নয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৫০ বছর আগেও হাসপাতালে সাত রকমের ডায়েট দেয়া হতো। সময়ের পরিক্রমায় তা বিলুপ্ত হয়েছে। দেশের সরকারি হাসপাতালে রোগীদের জন্য সঠিক ডায়েটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। রোগীভেদেও খাবারের পরিমাণ ও ধরন ভিন্ন হওয়া উচিত। তবে যথাযথ পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতে সরকারের বাড়ানো বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. খলিলুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রতি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের জন্য সাধারণত ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ক্যালোরি খাবার প্রয়োজন। রোগভেদেও ডায়েটের ভিন্নতা রয়েছে। বিভিন্ন রোগীর জন্য অন্তত তিন ধরনের ডায়েট দরকার। কিন্তু যে বরাদ্দ বড়ানো হয়েছে তাতে খাবারের পরিমাণ বাড়ানো কঠিন হবে।
সরকারের তথ্য বলছে, সারা দেশে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ ১০, ২০, ৩১, ৫০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে ৪৮৫টি। মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০০ থেকে ২৫০ শয্যার ৬২টি জেলা, ৫০০ শয্যার জেনারেল হাসপাতাল ও এক থেকে আড়াই হাজার শয্যার টারশিয়ারি (বিশেষায়িত) পর্যায়ের ৩০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ৪৯ হাজারের কিছু বেশি শয্যা। আর সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে শয্যা রয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৪টি। যদিও সরকারি হাসপাতালের মধ্যে মাধ্যমিক ও টারশিয়ারি পর্যায়ের শয্যার চেয়ে দ্বিগুণ রোগী ভর্তি থাকছেন।
বরাদ্দ ধীরে ধীরে বাড়ানোর বিকল্প নেই বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রস্তাবে অর্থ বিভাগ যে বরাদ্দ বাড়িয়েছে তাতে আগের চেয়ে নিঃসন্দেহে রোগীরা ভালো খাবার পাবেন। একবারে অনেক বেশি বাড়ানোও যায় না। ধীরে ধীরে বাড়াতে হয়।