বাংলাদেশে অপুষ্টি ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। পুষ্টির ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ভারসাম্যহীন পুষ্টির প্রভাব এখনো পুরোপুরি কাটিয়ে ওঠা যায়নি। ভারসাম্যহীন পুষ্টির বড় উদাহরণ দেশে স্থূলকায় মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া। স্থূলতা বা অতিরিক্ত ওজন-সংক্রান্ত এ সমস্যা মূলত গত দেড় দশকে বেড়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের নারীদের মধ্যে স্থূলতা বেড়েছে তিন গুণ, যার প্রভাবে বেড়েছে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা। এসবের কারণ হিসেবে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ পরিস্থিতির কথাই উল্লেখ করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক এক গবেষণা বলছে, দেশে নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যে ওজন কমে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে। ২০০৪ সালে নারীদের ওজন কমে যাওয়ার হার ছিল ৩৩ শতাংশ, যা ২০১৮ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে। একইভাবে পুরুষদের ক্ষেত্রে তা ২৬ থেকে নেমে ১৮ শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে ২০০৪ সালে নারীদের অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার হার ১৭ শতাংশ থাকলেও ২০১৮-তে এসে তা ৪৯ শতাংশ হয়েছে। আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ২১ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
ওজন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেড় দশকের ব্যবধানে উচ্চরক্তচাপে ভোগা নারী ও পুরুষদের মধ্যে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস সমানুপাতিক হারে বেড়েছে। একটা সময় গ্রামীণ দরিদ্র পরিবারগুলোয় কম ওজন ও শহরের পরিবারগুলোয় অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে ভোগা নারী-পুরুষ দেখা গেলেও বর্তমানে সে অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জার্নাল প্রকাশনা সংস্থা পাবলিক লাইব্রেরি অব সায়েন্সের পিএলওএস ওয়ান চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ‘আন্ডারওয়েট, ওভারওয়েট অর ওবেসিটি, ডায়াবেটিস অ্যান্ড হাইপারটেনশন ইন বাংলাদেশ ২০০৪ টু ২০১৮’ শিরোনামের ওই গবেষণার ফল প্রকাশ করে। গবেষণায় বাংলাদেশে জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০০৪, ২০০৭, ২০১১, ২০১৪ ও ২০১৮-এর তথ্য নেয়া হয়েছে। এতে ১৫ থেকে ৪৯ বছরের সাড়ে ৭০ হাজার নারী ও ১৮ থেকে ৯৫ বছরের প্রায় ১১ হাজার পুরুষের তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভিয়েতনাম, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিনটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সাত গবেষক এতে কাজ করেছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, শরীরে অস্বাভাবিক বা অত্যধিক চর্বি জমে যাওয়া অর্থাৎ স্থূলতা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বডি মাস ইনডেক্স (একজন ব্যক্তির ওজন কেজিতে বা পাউন্ড ও উচ্চতা মিটার বা ফুট দ্বারা ভাগ করা হয়, যা শরীরের চর্বি নির্দেশ করে) ২৫-এর বেশি হলে তাকে অতিরিক্ত ওজন বিবেচনা করা হয়। আর ৩০-এর বেশি হলে তাকে বলা হয় স্থূলতা।
২০১৭ সালের একটি পরিসংখ্যানে দেখা গিয়েছে, স্থূলতার কারণে সৃষ্ট নানা জটিলতায় বছরে বিশ্বের ৪০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বজুড়েই প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের মধ্যে স্থূলতার হার বাড়ছে। ১৯৭৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী অতিরিক্ত ওজন বা স্থূল শিশু ও কিশোর-কিশোরীর হার ৪-১৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, ২০০৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেড় দশকে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলকায় নারীর সংখ্যা বেড়েছে। রংপুর বিভাগে ২০০৪ সালে নারীদের মধ্যে স্থূলতার সমস্যা শূন্য শতাংশ ছিল। ২০১৮ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৪০ শতাংশে। একইভাবে রাজশাহীতে ১৪ শতাংশ থেকে ৪৬, সিলেটে ১৫ শতাংশ থেকে ৩৫, ঢাকায় ২০ শতাংশ থেকে ৫৫, খুলনায় ১৯ শতাংশ থেকে ৫২, বরিশালে ১৪ শতাংশ থেকে ৪৮ এবং চট্টগ্রামে ১৮ থেকে ৫৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পুরুষদের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতার হার নারীদের চেয়ে কম। ২০০৪ ও ২০০৭ সালে উল্লেখযোগ্য না হলেও ২০১৮ সালে এসে রংপুরে ১৮ শতাংশ, রাজশাহীতে ২৮, ঢাকায় ৩৮, সিলেটে ২৫, খুলনায় ৩৬, বরিশালে ৩০ এবং চট্টগ্রামে অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলকায় পুরুষের হার ৪০ শতাংশে দাঁড়ায়। এ পরিসংখ্যানে ময়মনসিংহ বিভাগের তথ্য ঢাকা বিভাগের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে।
স্থূলতা উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এসব রোগ অসংক্রামক হলেও স্থূলতার কারণে তা বৃদ্ধির পরিমাণ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, গত কয়েক দশকে অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতা বৃদ্ধির কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ, খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারের পরিবর্তন। ওজন অতিরিক্ত মাত্রায় বেড়ে গেলে শরীরে উচ্চরক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগ যেমন— হূদরোগ, ডায়াবেটিস, মস্তিষ্কে স্ট্রোক, অস্থির প্রদাহ, পিত্তথলিতে পাথর, বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার, শ্বাসকষ্ট, ঘুমে ব্যাঘাত, নানা ধরনের ত্বকের রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। চর্বি রক্তনালিতে স্বাভাবিক রক্তপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে, যা থেকে নানা ধরনের সংকটের সৃষ্টি হয়।
অপুষ্টির দুটি দিকের একটি স্থূলতা উল্লেখ করে ডব্লিউএইচও বলছে, সাব-সাহারান আফ্রিকা ও এশিয়া ছাড়া প্রতিটি অঞ্চলে কম ওজনের তুলনায় স্থূল মানুষের সংখ্যা বেশি। একসময় শুধু উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে স্থূলতা সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হলেও তা এখন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বাড়ছে। বেশি ওজন বা স্থূল শিশুর অধিকাংশই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাস করে। উন্নত দেশগুলোর চেয়ে এসব দেশে অতিরিক্ত ওজনের শিশু বৃদ্ধির হার ৩০ শতাংশের বেশি।
স্থূলতার কারণে উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস বেড়েছে বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ২০১১ সালের চেয়ে ২০১৮ সালে সারা দেশে উচ্চরক্তচাপে ভোগা নারীদের হার ৩১ থেকে ৪৪ শতাংশে ও পুরুষের হার ১৯ থেকে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ সময়ের ব্যবধানে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হারও ১১ থেকে ১৪ শতাংশে পৌঁছেছে।
গত তিন দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি পুষ্টির অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯০ ও ২০১০ সালের মধ্যে মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০০ সালে ছিল ৪৯ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ক্রমবর্ধমান আয় ও দ্রুত নগরায়ণের কারণে নাগরিকদের শারীরিক পরিশ্রম বা ক্রিয়াকলাপের পরিমাণ কমেছে। দেশের শহরগুলোর পরিধি বাড়লেও তা অপরিকল্পিত। জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলো সেখানে উপেক্ষিত। ফুটপাত, পার্ক, খেলার জায়গাসহ বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। নাগরিকরা কায়িক পরিশ্রম, মানসিক প্রশান্তি থেকে দূরে। গ্রামগুলোও এমন পরিস্থিতির বাইরে নয়। পাশাপাশি খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী খাদ্যের বদলে অস্বাস্থ্যকর ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের ওপর মানুষ বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রধানতম অসংক্রামক রোগ উচ্চরক্তচাপ বিশ্বব্যাপী রোগের বোঝা বাড়িয়েছে। ২০০০ সালে সারা বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে উচ্চরক্তচাপ ছিল। যে হারে রোগটিতে আক্রান্তের পরিমাণ বাড়ছে তাতে ২০২৫ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ৬০ শতাংশ বাড়বে। উচ্চরক্তচাপ হূদরোগের আশঙ্কাও চার গুণ বাড়ায়।
ডায়াবেটিস মেলিটাস ও উচ্চরক্তচাপ দুটি আন্তঃসম্পর্কিত রোগ উল্লেখ করে ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ দুটি রোগে আক্রান্তরা হূদরোগ, স্ট্রোক হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কিডনি, চোখের রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ও প্রজননক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়।
তবে উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধযোগ্য উল্লেখ করে জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, যেসব কারণ উচ্চরক্তচাপের জন্য দায়ী তা আমরা প্রতিরোধ ও প্রশমন করতে পারি। যদিও দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগ অনেক রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। ফলে দেশে এখন উচ্চরক্তচাপের পাশাপাশি অন্যান্য অসংক্রামক রোগের সংখ্যাও বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জীবনাচার ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের কারণে স্থূলতা বেড়েছে। গ্রামগুলোও নগরায়ণের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তবে তা অপরিকল্পিত। খেলাধুলা নেই বললেই চলে। গ্রামের প্রতি পাড়ায় শিশুরা খেলছে না। মধ্যবয়স্করা কায়িক পরিশ্রম কমিয়ে দিয়েছে। তৈলাক্ত ও ভাজা-পোড়া খাবার বাড়িতেও আয়োজন করে খাওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে লবণ ও চিনি খাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এসব স্থূলতা বৃদ্ধির কারণ। আর স্থূলতা বহু অসংক্রামক রোগের প্রধান কারণ। নীতিনির্ধারকরা জনস্বাস্থ্যের বিষয়গুলোকে কম গুরুত্ব দিয়েছেন। সবকিছু মিলিয়েই আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।