মেহেরপুর সদর উপজেলার আমঝুপি ইউনিয়নের পঁচাত্তর-ঊর্ধ্ব আক্কাস আলীর হঠাৎ হৃদযন্ত্রে ব্যথা শুরু হয় গত ৬ নভেম্বর। এর সাতদিন পর তাকে ঢাকার বাংলাদেশ হার্ট ফাউন্ডেশন হয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নেয়া হয়। বিশেষায়িত চিকিৎসা শুরুর ক্ষেত্রে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে তার স্বজনরা পল্লী চিকিৎসক ও বেসরকারি হাসপাতালে নেয়ার কথা জানান। তবে হৃদযন্ত্রে গুরুতর সমস্যা না থাকায় চিকিৎসায় বিলম্ব হওয়ার প্রভাব তেমন একটা পড়েনি। অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোম বা হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসার শুরুতে এমন দেরি জীবনের ঝুঁকি বাড়ায় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীরা শুরুতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনার কাছে চিকিৎসা নিতে গেলে তাদের ক্ষেত্রে বিশেষায়িত চিকিৎসাকেন্দ্রে রেফার হতে দেরি হয়। আর যারা সরকারি উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছেন তাদের চিকিৎসাকেন্দ্রে আসতে দেরি হয়েছে কম। সম্প্রতি এক গবেষণায় বিষয়টি উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, মানুষের হৃদযন্ত্রে হঠাৎ করে রক্তপ্রবাহ কমার সমস্যাকেই বলা হয় অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোম। এক্ষেত্রে হূিপণ্ডে রক্তপ্রবাহে সাহায্যকারী করোনারি আর্টারিতে ব্লক তৈরি হয়। ফলে রক্ত চলাচলে বাধার সৃষ্টি হয়। এ রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে বুকে ব্যথা বা অস্বস্তিবোধ প্রধান। এতে হূিপণ্ডের পেশি পর্যাপ্ত রক্ত সঞ্চালন করতে পারে না। এছাড়া বুকে চাপ বা চাপের মতো ব্যথা অনুভূত হয়। কাঁধ, বাহু, ঘাড়, চোয়াল বা পিঠেও ব্যথা হতে পারে। বদহজমের মতো মনে হতে পারে।
হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ কমে গেলে তা হার্ট অ্যাটাকের পর্যায়ে চলে যেতে পারে। এজন্য স্বল্প সময়ের মধ্যে সঠিক চিকিৎসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দেশে অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীর ৩৮ শতাংশই প্রথম চিকিৎসাসেবা পাচ্ছে ১২ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর। আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রথমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে গেলে সেখান থেকে যথাযথ চিকিৎসাকেন্দ্রে রেফার হয়ে আসতে দেরি হয় সবচেয়ে বেশি। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল প্রকাশনা সংস্থা এমডিপিআইয়ের মেডিসিনায় ‘ফ্যাক্টস রেসপন্সিবল ফর প্রিহসপিটাল ডিলে ইন পেশেন্ট উইথ অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোম ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণাটি প্রকাশ হয়। এতে বাংলাদেশ, কাতার, যুক্তরাষ্ট্র ও নেপালের ১৭ জন গবেষক কাজ করেছেন।
হৃদরোগের চিকিৎসা সুবিধাবিশিষ্ট সরকারি ২১টি জেলা ও ৬টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের তথ্য নিয়ে করা হয় এ গবেষণা। এতে ৩০ জেলার পৌনে সাতশ অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমের রোগীর তথ্য নেয়া হয়েছে। গবেষণায় বিশ্লেষণ করা হয়েছে রোগীদের বয়স, বাসস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের অবস্থান, বিশেষায়িত হাসপাতালে পৌঁছতে বিলম্বের কারণ। একই সঙ্গে উপসর্গের সূত্রপাতের অবস্থান, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসা শুরু, প্রথম মেডিকেল যোগাযোগের অবস্থানের দূরত্ব, হাসপাতালে ভর্তির সিদ্ধান্ত, উপসর্গ সম্পর্কে অজ্ঞতা ও পরিবহনের পদ্ধতিগুলো হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুকে বিলম্বিত করার ক্ষেত্রে প্রভাবক।
হৃদযন্ত্রে রক্তের প্রবাহ কমে গেলে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার আওতায় আনলে রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কম থাকে বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. চৌধুরী মেসকাত আহম্মেদ। তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব এ ধরনের রোগীকে চিকিৎসা দিতে হবে। হূিপণ্ডে রক্ত জমাট বেঁধে করোনারি সিনড্রোম হয়। ১২ ঘণ্টার মধ্যে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে পারলে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করা যায়। আর রিং বসানোর সুযোগ থাকলে ১২ ঘণ্টার মধ্যে হলে অনেক ভালো হয়। আমাদের এখানে যেসব রোগী চিকিৎসার জন্য আসছেন তাদের মধ্যে ৫০ শতাংশই দেরিতে আসছেন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব রোগী শুরুতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার দ্বারস্থ হয়েছিলেন তারা হৃদরোগের চিকিৎসা পাওয়া যায় এমন হাসপাতালে পৌঁছেছেন সবচেয়ে দেরিতে। প্রথমে বেসরকারিতে আসা ৬০ শতাংশ রোগী সঠিক চিকিৎসাকেন্দ্রে গিয়েছেন ১২ ঘণ্টা পরে। এতে হৃদযন্ত্রে রক্তপ্রবাহ কমে যাওয়া রোগীদের জরুরি চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয় ও জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয়। তবে সরকারি পর্যায়ের উপজেলা, জেলা ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গেলে সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে হৃদরোগের চিকিৎসাসংবলিত হাসপাতালে রেফারে সময় কম লাগে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসা রোগীদের মধ্যে ২৯ শতাংশ, জেলা হাসপাতালে আসা রোগীদের ২৮ শতাংশ ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসা রোগীদের ৩৪ শতাংশ উপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যান ১২ ঘণ্টা পরে।
গবেষকদের অন্যতম ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. ফখরুল ইসলাম খালেদ বণিক বার্তাকে বলেন, বুকে চাপ বা ব্যথা অর্থাৎ লক্ষণ শুরু (অনসেট অব সিম্পটম) থেকে ফার্স্ট মেডিকেল কন্টাক্ট অর্থাৎ যেখানে হার্ট অ্যাটাক রোগ নির্ণয় করার মতো চিকিৎসক ও ডায়াগনস্টিক সুবিধা আছে—এ সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, উপজেলা বা জেলা পর্যায়ে বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে সরকারি হাসপাতালে প্রথম হাজির হওয়া রোগীর হার্ট অ্যাটাক রোগ নির্ণয় ও উপযুক্ত রেফারাল করা হয়েছে। দুই ঘণ্টার মধ্যে এনজিওগ্রাম করতে না পারলে রক্তনালির তাত্ক্ষণিক ব্লক পরিষ্কার করতে থ্রম্বোলাইটিক ইনজেকশন দিতে হবে। ইনজেকশন দেয়া হলে এনজিওগ্রাম করার জন্য ৩ থেকে ২৪ ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। রোগ নির্ণয়ের পর ওষুধ দিতে হয়। এর মধ্যে ফার্স্ট মেডিকেল কন্টাক্ট সময়টা গুরুত্বপূর্ণ। বেসরকারিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক না থাকা, রোগ নির্ণয় সুবিধার অভাব ও ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে রোগী রেফার করতে দেরি হয়।
বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ও ক্লিনিক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ প্রাইভেট ডায়াগনস্টিক ক্লিনিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. মাইনুল আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, জেলা-উপজেলায় সরকারি ও বেসরকারি সব ধরনের হাসপাতালে এমনটি হতে পারে। কেননা হৃদযন্ত্রের রোগ নির্ণয় ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। যখনই এ ধরনের রোগী আসে তখনই বিশেষায়িত হাসপাতালে রেফার করা উচিত। তবে শুধু বেসরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা সঠিক চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠাতে দেরি করে এমনটি সঠিক নয়।
বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর ৩২ শতাংশই ঘটছে অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোমের কারণে। প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর প্রধান কারণ এটি। চিকিৎসার অগ্রগতি সত্ত্বেও উচ্চ অসুস্থতা ও মৃত্যুর কারণে করোনারি সিনড্রোম শীর্ষস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশে গ্রামীণ এলাকার রোগীদের হাসপাতালে বিলম্বিত হওয়ার ঘটনা বেশি। চিকিৎসাসেবার অপর্যাপ্ততা বড় ধরনের প্রভাবক। দেশের বেশির ভাগ স্বাস্থ্যসেবা শহরভিত্তিক হওয়া এ সমস্যার বড় কারণ।
প্রাথমিক পর্যায়ের সেবার পরিধি বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষ করে উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের অভাব রয়েছে। ছুটির দিনে শহর থেকে যেসব চিকিৎসক যান তাদের ওপর এসব হাসপাতাল নির্ভরশীল। সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। ফলে তারা সঠিক চিকিৎসা কেন্দ্রে রোগী পাঠাতে দেরি করে। একই সঙ্গে তাদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিও রয়েছে। রোগী ছাড়তে চায় না। দেশের সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক সেবার পরিধি বাড়ানো উচিত। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যে শুধু পরিবার পরিকল্পনা, স্যালাইন, ভিটামিন নয় তা নীতিনির্ধারকদের বোঝা উচিত। একই সঙ্গে বেসরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক সেবার পরিধি বাড়ানোর বিষয়ে জোর দেয়া উচিত।
বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নয়নে এগিয়ে থাকার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গড় আয়ুও বাড়ছে। দেশে রোগে মৃত্যুর দশ কারণের মধ্যে নয়টিই অসংক্রামক রোগ। বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মৃত্যুর অন্যতম কারণ হচ্ছে অ্যাকিউট করোনারি সিনড্রোম। গ্রামীণ চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তবে জেলা পর্যায়ের সব সরকারি হাসপাতালে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে না। একই সঙ্গে দেশের কোনো স্তরেই একটি শক্তিশালী রেফারেল ব্যবস্থা নেই। ফলে কোনো হাসপাতালে রোগী গেলে সেখান থেকে সঠিক হাসপাতালে পাঠাতে সময়ক্ষেপণ হয় বেশি। রোগী অনেক ক্ষেত্রে নিজেই রোগের চিকিৎসার বিষয় নির্ধারণ করেন এবং সে অনুযায়ী হাসপাতালে যান। তবে অনেক হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা পাওয়া যায় না।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন বণিক বার্তাকে বলেন, হূিপণ্ডে রক্ত জমাট বেঁধে প্রবাহ কমে যায়। এ সময় জমাট বাঁধা রক্ত তরল করার ওষুধ রয়েছে। ৪ হাজার টাকার ওষুধও রয়েছে আবার পঞ্চাশ হাজার টাকার ওষুধও রয়েছে। ওষুধে প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের হৃদযন্ত্রের রক্তপ্রবাহ ঠিক হয়ে যায়। এরপর যথাযথ চিকিৎসার জন্য বিশেষায়িত হাসপাতালে পাঠানো উচিত। প্রথম ১২ ঘণ্টায় চিকিৎসাসেবা দেয়া উচিত। আবার এই ১২ ঘণ্টায় দুর্ঘটনাও বেশি হয়। এ বিষয় বিবেচনা করে প্রথমে হাসপাতালের চিকিৎসকরা হয়তো রেফার করতে ভয় পান। কারণ পথে কিছু ঘটে যাওয়ার শঙ্কা থাকে।