শারীরিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য সমানুপাতিক হারে গুরুত্বপূর্ণ। জনগোষ্ঠীকে মানবসম্পদ রূপে গড়ে তোলা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বা সমাজ ব্যবস্থার পরিপূর্ণ উন্নতির জন্য প্রয়োজন এ তিন ধরনের স্বাস্থ্যসেবার সমন্বয়। বিশ্বের সব দেশ শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য বহুমাত্রিক অসংখ্য কর্মসূচি এবং পদক্ষেপ নিয়েছে, তবে উপেক্ষিত মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি অবহেলিত।
দেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য মনোবিজ্ঞানী, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট বা স্নায়ু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, মনোরোগের নার্সসহ লোকবলের সংখ্যা অপ্রতুল। এতে ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। ফলে দেশে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর ৯২ শতাংশ থেকে যাচ্ছে চিকিৎসার বাইরে।
মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের সংকটের কথা বিভিন্ন সময় সরকার ও দেশী-বিদেশী বেসরকারি এবং দাতা সংস্থার তথ্যে উঠে এসেছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালের এক সমন্বিত তথ্যে সাম্প্রতিক সময়ের এ অপ্রতুলতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। ‘ডব্লিউএইচও স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ ফর মেন্টাল হেলথ’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে লোকবল ও প্রাতিষ্ঠানিক অপ্রতুলতার সঙ্গে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার পদক্ষেপের কথা তুলে ধরা হয়।
এতে দেখা যায়, দেশে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন ২৭০ জন, যা প্রতি এক লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ১৬ জন। মনোবিজ্ঞানী রয়েছেন ৫৬৫ জন। প্রতি লাখ জনসংখ্যার বিপরীতে মনোবিজ্ঞানীর হার শূন্য দশমিক ৩৪ জন। মনোরোগের নার্স রয়েছেন ৭০০। প্রতি লাখে এ হার শূন্য দশমিক ৪ জন। এসব বিশেষজ্ঞ বেশির ভাগই শহরভিত্তিক। যেসব সাধারণ নার্সকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় অন্তর্ভুক্ত করতে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছে তাদের দেশে মাত্র দুটি মানসিক হাসপাতালে সংযুক্ত করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশেষায়িত মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতাল ঢাকার জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে ৫০০ শয্যা রয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বরাদ্দের মাত্র ৫ শতাংশ দেয়া হয় মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য। এর মধ্যে ৬৭ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে অবকাঠামো নির্মাণে। দেশের ৫৬টি সরকারি হাসপাতালে (জেনারেল বা জেলা) মানসিক রোগীদের বহির্বিভাগে চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। এসব হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সাইকোট্রপিক ওষুধ থাকলেও অভাব রয়েছে ইনজেকশনযোগ্য অ্যান্টিসাইকোটিক ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় ওষুধের। একই সঙ্গে প্রকট মনোসামাজিক সেবার জন্য দক্ষ লোকবলের সংকট।
দেশের অন্যতম মানসিক হাসপাতাল পাবনা মানসিক হাসপাতাল। ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে ৩১টি চিকিৎসকের পদ রয়েছে। সংখ্যাটি অপ্রতুল হলেও বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটিতে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ১১ জন। এর মধ্যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাত্র তিনজন।
এ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাফকাত ওয়াহিদ বণিক বার্তাকে বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে রোগীদের সচেতনতা কম। মানসিক স্বাস্থ্য একটা সময় বিলাসিতার বিষয়বস্তু ছিল। যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল তারা মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে ওয়াকিবহাল। এখন মানসিক ব্যাধিগুলো আগের চেয়ে বেশি শনাক্ত হচ্ছে। এতে বোঝা যায়, আগের চেয়ে চিকিৎসার পরিসর বৃদ্ধি পেয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আইন ও নীতি রয়েছে। জাতীয় সংসদে ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮’ পাস হয়েছে। আছে ‘মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা ২০২২’। এছাড়া রয়েছে ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল ২০২২’। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা (এনসিডিসি)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, দেশে ১৮ বছরের বেশি বয়সী মানুষের ১৯ শতাংশ এবং ১৩ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। মানসিক রোগাক্রান্তদের মধ্যে ৯২ শতাংশ চিকিৎসার সেবা থেকে বঞ্চিত বা তারা চিকিৎসা নিতে আসছেন না।
মেজর ডিপ্রিসিভ ডিজঅর্ডার বা জটিল বিষণ্নতায় ভুগছেন ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ। বাইপোলার ডিজঅর্ডার রয়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের, সাইকোসিস রয়েছে ১ শতাংশের, উদ্বেগের মতো ব্যাধি রয়েছে ৫ শতাংশের, সাবস্ট্রেন্স রিলেটেড অ্যান্টি অ্যাডিকটিভ ডিজঅর্ডার বা পদার্থ সম্পর্কিত ও আসক্তিজনিত ব্যাধি রয়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশের, মৃগী রোগ রয়েছে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশের এবং আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু রয়েছে ৬ শতাংশের।
চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেহের সমস্যার মতোই মনের সমস্যাও এক ধরনের মৌলিক সমস্যা। এর সঙ্গে সামাজিক ও দৈহিক সমস্যা জড়িত, বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে বিলম্ব হয়েছে। আমরা মনে করি, দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অসুখই শুধু অসুখ। এ জায়গা থেকে বের হতে হবে। মানসিক সমস্যা শুনলেই আমাদের প্রথমে মাথায় আসে মনোরোগের কথা। তবে এর বাইরেও যে মূলত ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির একটা বড় ভূমিকা রয়েছে তা খুবই গুরুত্বহীনভাবে রয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় এখনো ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির কোনো পদ তৈরি হয়নি। বেশির ভাগ সমস্যাই সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব।’
তিনি আরো বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ২০-২৫ বছর আগে চালু হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি পড়ানো হয়। তবে এখনো কোনো প্রফেশনাল রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া হয়নি। প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার জন্য আমাদের বরাদ্দ কম। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যকে যুক্ত করতে হবে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অ্যাডাল্ট সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বণিক বার্তাকে বলেন, ১০ বছর বা কিছু সময় ধরে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে উন্নতি হচ্ছে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ২০১৮ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য আইন হওয়ার আগে ১৯১২ সালের একটি আইনে চলছিল। ২০২২ সালে মানসিক স্বাস্থ্যনীতি পাস হয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকৌশল ২০২০-৩০ পাস হয়েছে। এখন অবস্থা ভালো। জনবলের সংখ্যা গত এক দশকে বেড়েছে। অবকাঠামোগত দিক থেকে আশানুরূপ উন্নতি না হলেও কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বর্তমানে চার জেলায় পাইলট প্রকল্প চলছে। নতুন একটি বিশেষ কর্মসূচি নেয়া হচ্ছে, যা ২০২৫ সাল থেকে বাস্তবায়ন শুরু হবে। অনেক দেশে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য আলাদা অধিদপ্তর থাকে, মন্ত্রণালয় থাকে। তবে আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে ন্যূনতম মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য একজন পরিচালকের অধীনে একটি শাখা চাচ্ছি।’