বায়ুদূষণে স্বল্পমেয়াদি-অসংক্রামক রোগে বেশি ভুগছেন অতিধনীরা

জীবন ধারণের জন্য বায়ু অপরিহার্য। তবে নানাভাবে এ বায়ু দূষিত হয়ে মানুষের মৃত্যুরও কারণ হচ্ছে। প্রভাবিত করছে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগকে। দূষণে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দূষিত শহরের তালিকায় রাজধানী ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়। শুধু বায়ুদূষণের কারণে বছরে মারা যাচ্ছে পৌনে এক লাখ মানুষ। অর্থনৈতিক ক্ষতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ শতাংশের বেশি। অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও নগরায়ণের কারণে পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। স্বল্পমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ। এসব রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে অতিধনী জনগোষ্ঠী। এমনটাই দাবি করেছে বিশ্বব্যাংক।

গত ডিসেম্বরে ‘ব্রেদিং হেভি: নিউ এভিডেন্স অন এয়ার পলিউশন অ্যান্ড হেলথ ইন বাংলাদেশ’ শিরোনামে বায়ুদূষণের ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। এ প্রতিবেদন তৈরিতে ঢাকা ও সিলেটের চার অঞ্চল থেকে ১২ হাজার ২৫০ জনের তথ্য ব্যবহার করে বায়ুদূষণের কারণে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্বল্পমেয়াদি প্রভাব মূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটার চুল্লি দিয়ে নির্গত কালো ধোঁয়া, শুষ্ক মৌসুমে অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামতের কারণে সৃষ্টি হওয়া ধুলা ও ইটভাটার ধোঁয়ার দূষণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যানজট ও নির্মাণাধীন প্রকল্পের কারণে যে পরিমাণ বায়ুদূষণ হয় তা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বায়ুমানের চেয়ে ১৫০ শতাংশ বেশি। আর ইটভাটার কারণে যে দূষণ হয় তা ১৩৬ শতাংশ বেশি?

বিশ্বব্যাংক বলছে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ বেড়েছে। এর প্রভাবে বাড়ছে নানা ধরনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা। ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মৃত্যু ও শারীরিক অক্ষমতার দ্বিতীয় বৃহত্তম ঝুঁকি ছিল বায়ুদূষণ। ওই বছর বায়ুদূষণের কারণে মৃত্যু হয়েছিল ৮০ হাজার মানুষের। দেশে মৃত্যুর প্রধান শীর্ষ চারটি কারণকে প্রভাবিত করছে বায়ুদূষণ। এগুলো হলো স্ট্রোক, হূদযন্ত্রের জটিলতা, দীর্ঘস্থায়ী অবরোধক ফুসফুসীয় ব্যাধি (ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ-সিওপিডি) ও শ্বসনতন্ত্রের সংক্রমণ।

গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, বায়ুদূষণের কারণে স্বল্পমেয়াদি রোগ (১ থেকে ১৪ দিন), দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন অতিধনীরা। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠীকে সম্পদের ভিত্তিতে হতদরিদ্র, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, ধনী ও অতিধনী—এ পাঁচ ভাগে ভাগ করেছে বিশ্বব্যাংক। স্বল্পকালীন রোগের মধ্যে কাশিতে আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ শতাংশ অতিধনী ব্যক্তি। একইভাবে শ্বাসকার্যে সমস্যায় ভুগছেন ৫ শতাংশ, জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন ২১ শতাংশ, চোখের সমস্যায় ভুগছেন ১০ শতাংশ ও ত্বকের অবস্থাজনিত সমস্যায় রয়েছেন ১২ শতাংশ উচ্চধনী। একইভাবে বায়ুদূষণের কারণে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে বেশি থাকছেন তারা। ওই পাঁচ শ্রেণী বিভাজনের জনগোষ্ঠীর মধ্যে অ্যালার্জিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন অতিধনীরা। এ হার ২২ শতাংশ। একইভাবে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন ৮ শতাংশ, হূদযন্ত্রের জটিলতায় ভুগছেন ৩ শতাংশের বেশি, উচ্চ রক্তচাপের ভুক্তভোগী ১২ দশমিক ৩ শতাংশ, স্ট্রোকের ঝুঁকিতে ১ দশমিক ৪ এবং দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় ভুগছেন ৩ শতাংশ অতিধনী ব্যক্তি।

ওই গবেষণার গবেষক ও বিশ্বব্যাংকের (বাংলাদেশ) স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ওয়ামেক আজফার রেজা বণিক বার্তাকে বলেন, জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে সম্পদের অনুপাতে জনগোষ্ঠীর শ্রেণী বিভাজনের পদ্ধতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে অনুসরণ করা হয়েছে। এতে জনগোষ্ঠীকে হতদরিদ্র, দরিদ্র, মধ্যবিত্ত, ধনী ও অতিধনী—এ পাঁচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। আমরা নিপোর্টের মতোই পাঁচটা কোয়ান্টাইলে বিভাজন করেছি। কেন অতিধনীরা স্বল্পমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন, তার খুব ভালো ব্যাখ্যা দেয়া যায়নি। হতে পারে অতিধনীদের কায়িক শ্রম কম হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বেশি। তাদের উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা বা ওজনও বেশি হয়। বিষয়টি নিয়ে অধিকতর গবেষণা প্রয়োজন।

গবেষণা বলছে, দেশের মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব রয়েছে। বায়ুদূষণ শ্বাসকষ্ট, কাশি, শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের পাশাপাশি বিষণ্নতা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। যাদের আগে থেকেই ডায়াবেটিস, হূদরোগ বা শ্বাসযন্ত্রের রোগ রয়েছে তাদের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। অধিক ভবন নির্মাণ ও যানবাহন অধ্যুষিত এলাকায় বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ইটভাটার কাছাকাছি এলাকায় বাতাসে ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া যায়।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, বায়ুদূষণের কারণে প্রভাব পড়ছে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর। দূষিত এলাকাগুলোর মধ্যে বিষণ্নতায় ভুক্তভোগী পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ব্যক্তির মধ্যে দিন দিন বিষণ্নতার মাত্রা বাড়ছে। আর পুরুষের চেয়ে নারীরা ভুক্তভোগী বেশি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুর মান বিষয়ক গবেষক অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অতিধনীদের ঘরে বা গাড়িতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা ও বায়ু পরিষ্কারক যন্ত্রের ব্যবস্থা থাকে। ফলে ওইসব ব্যক্তি যখন সেই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে বাইরের সাধারণ পরিবেশে আসেন তখন তাদের ওপর দূষণের প্রভাব বেশি পড়ে। স্বাভাবিকভাবে বাইরের পরিবেশে তাদের মানিয়ে নেয়ার সক্ষমতা কম। ফলে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। আর নিম্নবিত্তরা সব সময়ই উচ্চমাত্রার দূষণের মধ্যে থাকায় তাদের মধ্যে এর প্রভাব কম হতে পারে। দূষণ প্রতিরোধের শারীরিক সক্ষমতা নিম্নবিত্তদের বেশি থাকতে পারে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রযুক্তির উত্কর্ষে মানুষ আগের মতো কায়িক পরিশ্রম করে না। ফলে তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগ বাড়ছে। এসব রোগ অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারণের ফলে সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো দেশের জনগোষ্ঠীর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে ডায়াবেটিস দেখা যাচ্ছে। এর মূল কারণ শ্রমহীনতা, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার গ্রহণ, প্রক্রিয়াজাত খাবার ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার। অতিধনীদের দৈহিক-মানসিক কতগুলো পরিবর্তনের কারণে তারা বেশি আক্রান্ত হতে পারেন। স্থূলতা একটি নীরব মহামারী হয়েছে, যা মানুষ এখনো বুঝতে পারছে না। ফলে একটু ধাক্কায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে তারা।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বণিক বার্তাকে বলেন, বায়ুদূষণের মাধ্যমে কিছু রাসায়নিক ও ভারী ধাতু শরীরে যায়। এগুলোতে সাধারণত ক্ষতিকর রাসায়নিক ও বায়োকেমিক্যাল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। প্রাণরাসায়নিক বায়োকেমিক্যাল পরিবর্তন হয় শরীরে। এই যে পরিবর্তন, এটা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে যাদের ওজন অধিক বেড়ে গেছে অথবা দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত তাদের। মূলত একটি বিষয়ের সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কযুক্ত। যারা কায়িক শ্রম কম করবে, তাদের শরীরে ইনসুলিন কম কাজ করে। সাম্প্রতিক সময়ে আমরা করোনা মহামারীকে মোকাবেলা করেছি। আর নীরব মহামারী হচ্ছে ওজনাধিক্য, অলসতা, কায়িক শ্রমহীনতা। এগুলো ধনী ও অতিধনীর মধ্যে বেশি। কভিডের সময়ও দেখা গেছে, যারা কায়িক শ্রম বেশি করেছে তারা কম আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত হলেও জটিলতা কম ছিল। আর স্থূল ব্যক্তিদের জটিলতা বেশি ছিল। ভাইরাস ধনী বা গরিব চেনে না। ভাইরাস বোঝে রোগ প্রতিরোধের শারীরিক সক্ষমতা। অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের কারণে যে রোগ সৃষ্টি হয়, তা মূলত সভ্যতার অভিশাপ। আমরা লোকজন দিয়ে কাজ করিয়ে নিই। অতি প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাচ্ছি। এতে শরীর ধীরে ধীরে ক্ষতির দিকে যাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে এ শ্রেণীর ব্যক্তি বেশি ক্ষতির শিকার হয়।

Source: Bonik Barta

Share the Post: