সিটি মেডিকেল কলেজ: ভাড়া ভবনে একাডেমিক কার্যক্রম, হাসপাতালের অধিকাংশ শয্যা ফাঁকা

নিজস্ব জমি ও ভবনে মেডিকেল কলেজ পরিচালনার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। একই ক্যাম্পাসে হাসপাতাল থাকাও প্রধান শর্তের একটি। অথচ তার কোনোটাই মানছে না বেসরকারি সিটি মেডিকেল কলেজ। ঢাকার অদূরে গাজীপুরের একটি ভাড়া ভবনে চলছে এর কার্যক্রম। কলেজ বা হাসপাতালের জন্য নেই শর্তানুযায়ী ফ্লোর স্পেস। শিক্ষকের সংকট, নেই পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষ ও গ্রন্থাগারের সুবিধা। হাসপাতালে নেই প্রয়োজনীয় শয্যা ও জরুরি পরিষেবা। স্বাস্থ্যশিক্ষা উপযোগিতার এসব ঘাটতি পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় অনুমোদনের কয়েক বছরের মাথায় সিটি মেডিকেল কলেজের কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেয়া হয়। পরে অবশ্য শর্তসাপেক্ষে তা প্রত্যাহার হয়। এরপর কেটে গেছে পাঁচ বছর। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এসব শর্ত এখনো পূরণ করেনি কর্তৃপক্ষ। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর কলেজটির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান।

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গাজীপুরে বেসরকারি সিটি মেডিকেল কলেজ ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৫০টি আসনের বিপরীতে শিক্ষার্থী ভর্তির অনুমোদন পায়। প্রতিষ্ঠানটি সর্বশেষ একাডেমিক অনুমোদনের নবায়ন পায় ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য। সে সময় ৮০টি আসন অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও এরপর সাত শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছে। বর্তমানে রয়েছে ৩৩২ শিক্ষার্থী।

এদিকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন-২০২২ কার্যকর করে সরকার। এর আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা-২০১১ (সংশোধিত) অনুযায়ী বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো পরিচালিত হতো। কিন্তু আইন কার্যকর হওয়ার আগে নীতিমালাও মানেনি সিটি মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। কেননা আইনের আগে নীতিমালা অনুযায়ীও ৫০ শিক্ষার্থীর আসনবিশিষ্ট বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য মেট্রোপলিটন এলাকার ক্ষেত্রে কলেজের নামে দুই একর ও অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রে চার একর জমি থাকতে হবে। ওই জমিতে কলেজের মালিকানা হবে নিরঙ্কুশ, নিষ্কণ্টক, অখণ্ড ও দায়মুক্ত। কলেজ ও কলেজের হাসপাতাল কোনোক্রমেই ইজারাকৃত বা ভাড়া জমিতে কিংবা ভবনে স্থাপন করা যাবে না। অথচ সিটি মেডিকেল কলেজ চলছে ভাড়া ভবনে। এমনকি এসব শর্ত মানার কোনো পদক্ষেপও নেয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষ।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন অনুযায়ী গঠিত কমিটি কলেজগুলোকে পরিদর্শন শেষে শিক্ষার্থী ভর্তি কার্যক্রম অনুমোদনের সুপারিশ করে। সাধারণত প্রতি বছর পরিদর্শন করে কলেজের মূল্যায়ন প্রতিবেদন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে পাঠানো হয়। সিটি মেডিকেল কলেজ সর্বশেষ ২০২২ সালে পরিদর্শন করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নীতিমালা (২০২২ সালে আইন কার্যকর করার আগে নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করার বিধান রয়েছে) অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ সিংহভাগ শর্ত পূরণ করেনি সিটি মেডিকেল কলেজ।

পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী, কলেজের নামে নিজস্ব জমি নেই। বর্তমানে ভাড়া বাড়িতে কলেজের কার্যক্রম চলমান। কলেজের একাডেমিক কার্যক্রমে আইন অনুযায়ী ৫০ শিক্ষার্থীর জন্য এক লাখ বর্গফুট ফ্লোর স্পেস থাকতে হবে। আর ৮০ শিক্ষার্থীর জন্য কলেজের ফ্লোর স্পেস থাকতে হবে ১ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুট। তবে সিটি মেডিকেল কলেজের কার্যক্রমের জন্য ১ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ বর্গফুট ফ্লোর স্পেসের ঘাটতি রয়েছে। একইভাবে ৮০ শিক্ষার্থীর জন্য ১ লাখ ৬০ হাজার বর্গফুটের ফ্লোর স্পেস নিয়ে হাসপাতাল থাকার কথা থাকলেও তাতে ১ লাখ ২৭ হাজার বর্গফুট ফ্লোর স্পেসের ঘাটতি রয়েছে। নেই বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের অধিভুক্তির হালনাগাদ। ৮০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে হাসপাতালে ৪০০ শয্যা থাকার বাধ্যবাধকতা থাকলেও শয্যা আছে ২৫০টি। একই সঙ্গে ফ্রি শয্যা মার্ক করা নেই, নেই অক্সিজেন প্লান্ট। হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার (বেড অকুপেন্সি রেট) ৭০ শতাংশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু হাসপাতালটির অধিকাংশ শয্যা খালি পাওয়া গেছে। যেসব রোগী ভর্তি রয়েছে, তাদের অধিকাংশের বর্ণনা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রের নথিতে রয়েছে অসামঞ্জস্য। বেড অকুপেন্সি রেট মাত্র ১০ শতাংশ। নিয়ম অনুযায়ী কলেজের গ্রন্থাগারে অর্ধেক আসনের ঘাটতি রয়েছে। শ্রেণীকক্ষ, গ্যালারি ও মিউজিয়ামের আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনুপাত ১:১০ হওয়ার কথা। তবে অ্যানাটমি, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, কমিউনিটি মেডিসিন, ফরেনসিক মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, মাইক্রোবায়োলজি, প্যাথলজি বিভাগে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে।

বেতন ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিশোধ করা হয় না উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, শিক্ষকদের বেতন-ভাতাদি ব্যাংক ও নগদের মাধ্যমে নিয়মিত পরিশোধ করা হয় বলে জানানো হলেও সেসব বিষয়ে কোনো প্রমাণ কলেজ কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারেনি। কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স স্কিম কার্যক্রমেও রয়েছে ঘাটতি। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষার্থী ভর্তির সাময়িক স্থগিতাদেশ বেশকিছু শর্তসাপেক্ষে প্রত্যাহার করা হয়। এর মধ্যে শুধু স্থায়ী আমানত ও হাসপাতালে লিফট স্থাপন ব্যতীত কোনো শর্তই পূরণ করেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ। ফলে একামেডিক অনুমোদন নবায়নের সুপারিশ করেনি অধিদপ্তর।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ থেকে পশ্চিমে ইটাহাটায় সিটি মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাস। ছয়তলা ভাড়া ভবনে একাডেমিক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ভবনের নিচতলায় অভ্যর্থনা, দ্বিতীয় তলায় শ্রেণীকক্ষ, তিনতলায় অধ্যক্ষ ও কলেজের কার্যালয় ও অন্যান্য তলায় শ্রেণীকক্ষ।

কলেজ ভবন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে কলেজের হাসপাতাল। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের আউটপাড়ায় ছয়তলা ভবনে হাসপাতালের কার্যক্রম চলছে। হাসপাতাল ভবনের দ্বিতীয় তলায় চেয়ারম্যান সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীরের কক্ষ। তিনি সাধারণত এ কক্ষে বসেই কলেজ ও হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করেন বলে জানা যায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মকর্তারা জানান, হাসপাতালে সাধারণত রোগীর সংখ্যা খুব কমই থাকে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসা-সুবিধার অভাবে রোগীরা আসতে চায় না। এর বড় একটি কারণ এ হাসপাতালে নেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)।

একজন শিক্ষানবিশ চিকিৎসক জানান, শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একাডেমিক বিষয়গুলোর ঘাটতি রয়েছে। তবে বেশি ঘাটতি স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে। ফলে চিকিৎসাবিদ্যার প্রায়োগিক শিক্ষা থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন।

স্বাস্থ্যশিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে যেসব শর্ত মানতে হয়, তা মেনে বাংলাদেশে কলেজ খুলতে দেখা যায় না। মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অধিভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) প্রয়োজনীয় আইন বা নীতিমালার বাস্তবায়ন দেখবে। এ তিন কর্তৃপক্ষ যদি আইন অনুযায়ী কাজ করে, কোনো মেডিকেল কলেজ অসম্পন্ন ও ঘাটতি রেখে একাডেমিক ও হাসপাতাল কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। আইন না মেনে ইচ্ছামতো কলেজ পরিচালনা করলে সেখান থেকে চিকিৎসাবিদ্যায় ডিগ্রি অর্জনকারী চিকিৎসকরা ভালো সেবা প্রদানে ব্যর্থ হবেন। সরকারের তিনটি কর্তৃপক্ষের নীতিমালাগুলো মানতে বাধ্য করতে হবে অথবা নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে বা বন্ধ করে দিতে হবে। চিকিৎসাশিক্ষার বিষয়ে আপস করলে বাংলাদেশের চিকিৎসক ও চিকিৎসাসেবার মান হবে সর্বনিম্ন।

ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বেশির ভাগ কলেজে সরকারের আইন বা নীতিমালা অনুযায়ী যতটা জায়গা থাকার দরকার, সেটা নেই। অদূরভবিষ্যতে ওই আইন মেনে যে মেডিকেল কলেজ করতে হবে, তেমনটা সরকারও নির্দিষ্ট করে দেয় না। আর দিলেও সেটা মানা হয় না। এমন চর্চা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সরকার মোটামুটি দেখেও দেখছে না। ফলে তারা প্রশ্রয় পাচ্ছে।’

সিটি মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. জেসমিন আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এরপর কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ও কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. গোলাম ইকবালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কলেজের পাশে জমি কিনেছি। আরো একটি জমি কেনার প্রক্রিয়া চলছে। কলেজ ভাড়া ভবনে হলেও হাসপাতাল নিজস্ব ভবনে। কলেজ ও হাসপাতাল দুই স্থানে এটা সত্য। রোগী কম, তবে হাসপাতালের বেড অকুপেন্সি রেট বাড়ানোর চেষ্টা করছি।’

ভাড়া ভবনে কলেজ বিষয়টি অস্বীকার করেন সিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. রেফায়েত উল্লাহ শরিফ। তিনি বলেন, ‘সব শর্ত মেনেই মেডিকেল কলেজ পরিচালিত হয়। নবায়নের সুপারিশও করা হয়েছে। নিজস্ব জমি ও ভবনও রয়েছে। কলেজ ভবন নিজস্ব, হাসপাতাল ভবনও নিজস্ব। এসব বিষয় মন্ত্রণালয় জানে। যখন মন্ত্রণালয় তথ্য হালনাগাদের জন্য বলে, আমরা তথ্য দিয়ে দিই।’

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কোনো ব্যক্তির প্রভাবে কখনই শর্ত শিথিল করা হয় না। অনেক মেডিকেল কলেজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। কেউ শর্ত না মানলে তাদের সতর্ক করা হয়। এর পরও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শর্ত পূরণ না হলে আমরা কলেজ বন্ধ করে দিই। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

(প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন গাজীপুর প্রতিনিধি হাজীনুর রহমান)

Source: Bonik Barta

Share the Post: