বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল উদ্বোধন করা হয়েছিল গত বছরের সেপ্টেম্বরে। অবকাঠামোর নির্মাণকাজ শেষ হলে এ হাসপাতাল উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে সে সময় এর কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। এরও তিন মাসের বেশি সময় পর চালু করা হয় কয়েকটি বহির্বিভাগ। দেশের সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়িত সেবার ক্ষেত্রে যুক্ত হওয়া এ হাসপাতালে অবশ্য এখনো রোগী ভর্তি শুরু হয়নি। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রোগী ভর্তির জন্য আরো তিন মাসের মতো সময় প্রয়োজন। অতিগুরুত্বপূর্ণ কিছু মেডিকেল যন্ত্রপাতি স্থাপনের জন্যই মূলত অপেক্ষার সময় বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হাসপাতালটি পুরোদমে চালু হলে দেশের চিকিৎসাসেবার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। হাতের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে সেবা পাবে সাধারণ মানুষ।
বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের ১৪টি বিভাগে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বিভাগগুলো হলো জেনারেল শিশু, অবস অ্যান্ড গাইনি, অফথালমোলজি (চক্ষু), বক্ষব্যাধি, নিউরোলজি, নেফ্রোলজি (কিডনি), ইউরোলজি, কার্ডিওলজি, কার্ডিয়াক সার্জারি (থোরাসিক সার্জারিসহ), সার্জিক্যাল অনকোলজি, অর্থোপেডিকস অ্যান্ড ট্রমা, হেপাটোলজি (লিভার), গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়েটিক সার্জারি বিভাগ। রোগীরা সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা ও বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত শুধু চিকিৎসকের পরামর্শ পাচ্ছে। এ সময় পরামর্শ দিচ্ছেন হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক পর্যায়ের চিবিৎসকরা। পর্যায়ক্রমে হাসপাতালের রোগীদের ইতিহাস স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির মাধ্যমে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করা হবে।
বিশেষায়িত এ হাসপাতালে শয্যা সংখ্যা ৭৫০। এখানে থাকছে ১৪টি আধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ১০০ শয্যার নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ), ১০০ শয্যার জরুরি ইউনিট, ছয়টি ভিভিআইপি, ২২টি ভিআইপি ও ২৫টি ডিলাক্স কেবিন। হাসপাতালের চিকিৎসাসেবার মধ্যে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, জিন থেরাপি ও রোবোটিক সার্জারির ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া অটিজম, মাতৃত্বকালীন যত্ন ও শিশুযত্ন, জরুরি চিকিৎসাসেবা, হেপাটোবিলিয়ারি ও গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, কার্ডিওলজি ও সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ, নেফ্রোলজি, শ্বাসযন্ত্র, সাধারণ অস্ত্রোপচার, চক্ষুবিদ্যা, দন্ত্যচিকিৎসা, চর্মরোগ বিদ্যা ও শারীরিক ওষুধ এবং পুনর্বাসনসেবা পাওয়া যাবে এ হাসপাতালে। স্বাস্থ্যসেবার জন্য বিশেষায়িত এ হাসপাতালে ৩০০ চিকিৎসকসহ প্রায় দেড় হাজার স্বাস্থ্যকর্মী কাজ করবেন। এর মধ্যে শতাধিক চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য কর্মকর্তা দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের অতিরিক্ত পরিচালক ডা. মো. রসুল আমিন শিপন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী এ হাসপাতাল গত ১৪ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন করেছেন। এরপর বহির্বিভাগের সেবা চালু হয়েছে গত ২৭ ডিসেম্বর। আমাদের এখানে জরুরি সেন্টার বাদে পাঁচটি সেন্টার রয়েছে। কার্ডিওভাসকুলার অ্যান্ড স্ট্রোক সেন্টার, অ্যাকসিডেন্টাল অ্যান্ড ইমার্জেন্সি সেন্টার, মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হেলথ সেন্টার, কিডনি অ্যান্ড ট্রান্সপ্লান্ট ও হেপাটোবিলিয়ারি অ্যান্ড প্যানক্রিয়েটিক সেন্টার। বর্তমানে ১৪টি বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দেন। প্রতিদিন দুই শিফটে চিকিৎসা দেয়া হয়। সম্প্রতি আমরা আমাদের ইমেজিং সেন্টার চালু করেছি। আমরা সিটি স্ক্যান ও এমআরআই চালু করেছি। বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন শতাধিক রোগী আসছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে এখানে পরীক্ষাগার চালু করার পরিকল্পনা রয়েছে। কার্ডিয়াক বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষাও এ মাসের মধ্যে চালু করা হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়। ২০১৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এ হাসপাতালের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের অর্থায়নে নির্মাণ করা হয় হাসপাতালটি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ভবনটিতে নয়টি ফ্লোর ও তিনটি বেজমেন্ট রয়েছে। সাধারণ শয্যা, আইসিইউ ছাড়াও আইসোলেটেড কেবিন, ওয়ার্ড, এসআইসিইউ, এনআইসিইউ, পিআইসিইউ, সিসিইউ, এমআইসিইউর ব্যবস্থা রয়েছে। এ হাসপাতালে যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতাল বা চিকিৎসক দ্বারা রেফার করা সব গুরুতর রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে। দৈনিক প্রায় পাঁচ থেকে আট হাজার রোগী হাসপাতালের বহির্বিভাগের সেবা পাবে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে দিনে দুই শিফটে কনসালটেশন চলছে। এখানে রোগ নির্ণয়ের কিছু ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে। তিন মাসের মধ্যে রোগী ভর্তির ব্যবস্থাও করা হবে। এখনো কিছু যন্ত্রপাতি এসে পৌঁছেনি। অপারেশন থিয়েটার চালু করতে হলে কিছু ভেন্টিলেটরসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ লাগবে। হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম এখনো এসে পৌঁছেনি। এর কারণ হলো কভিড সংক্রমণের কারণে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে শিপমেন্ট আসতে সমস্যা হচ্ছে। আমার মনে হয়, তিন মাসের মধ্যে এসে যাবে। অলরেডি ওখানে কাজ শুরু হয়ে গেছে।’
সম্প্রতি আলোচনায় আসা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘এখানে দিনে ও বিকালে ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিস চলে। একজন অধ্যাপক বাইরে যেমন ফি নেন, এখানেও তেমন নেয়া হবে। ফির কিছু অংশ তিনি পাবেন আর কিছু অংশ পাবে হাসপাতাল। রোগীরা বাইরেও সেবা নিতে পারবে, হাসপাতালেও নিতে পারবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাবে, প্রয়োজনে এখানে অস্ত্রোপচারও করা যাবে। এ বিষয়গুলোকে আমরা প্রাধান্য দিয়েছি। ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে সকালে হাসপাতালে যে কনসালটেশন করা হয় তাতে একজন অধ্যাপক ৬০০, সহযোগী অধ্যাপক ৪০০ ও সহকারী অধ্যাপক ৩০০ টাকা ফি নিচ্ছেন। আর বৈকালিক কনসালটেশনের জন্য অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপক যথাক্রমে ১ হাজার, ৮০০ ও ৬০০ টাকা ফি নিচ্ছেন।’
উদ্বোধনের পর পূর্ণাঙ্গ রূপে হাসপাতালটি চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. আব্দুল্লাহ আল হারুন বলেন, ‘বর্তমানে ১৪ বিভাগের বহির্বিভাগে কনসালটেশন চালু রয়েছে। এ সেবা আরো বিস্তৃতি লাভ করবে। বিশেষায়িত কনসালটেশন সেবা একটি সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সকালে সরকারিভাবে কনসালটেশন চলছে। আর বিকালে চলছে বৈকালিক কনসালটেশন। একেকজন বিশেষজ্ঞ বহির্বিভাগে ঘণ্টায় ছয়জনের বেশি রোগী দেখবেন না। এখানে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী অধ্যাপক সরসারি রোগীকে সেবা দিচ্ছেন। আমাদের উদ্দেশ্য উন্নত দেশে যেভাবে সেবা দেয়া হয় তার চেয়ে এ হাসপাতালের সেবা কোনো অংশে কম হবে না। যে ফি এখানে নির্ধারণ করা হয়েছে তা মানুষের সক্ষমতার বাইরে নয়। এ ফির মধ্যে ৪০ শতাংশ সার্ভিস চার্জ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
তিনি জানান, গত মাসে রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং চালু করা হয়েছে। এরপর কার্ডিওলজি অ্যান্ড স্ট্রোক, নেফ্রোলজি অ্যান্ড ইউরোলজি, ম্যাটার্নিটি অ্যান্ড চাইল্ডকেয়ার চালু হবে। একই সঙ্গে প্যাথলজিসহ বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এ হাসপাতালের ওপর মানুষের যে প্রত্যাশা রয়েছে তা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।