পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এসেছে পরিবর্তন। পরিকল্পিত নগরায়ণের চেয়ে অপরিকল্পিত নগরায়ণের পরিসর বেড়েছে। কাজের ধরন ও খাদ্যাভ্যাসসহ মানুষের জীবনাচারের পরিবর্তনে বেড়েছে রোগের প্রাদুর্ভাব। দেশে দীর্ঘদিন ধরে টেবিলভিত্তিক কাজ, কায়িক শ্রম কমিয়ে দেয়া এবং নিষ্ক্রিয় জীবনাচারে অভ্যস্তদের মধ্যে ঝুঁকি বেড়েছে ক্যান্সারের। বিশেষ করে সলিড টিউমার বা কঠিন টিউমার এ ক্যান্সারের কারণ। সাম্প্রতিক সময়ের এক গবেষণা বলছে, ক্যান্সারে আক্রান্তদের অর্ধেক ব্যক্তিই নিষ্ক্রিয় জীবনাচারে অভ্যস্ত।
শারীরিক ক্রিয়াকলাপের অভাব ব্যক্তির ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি)। সংস্থাটির মতে, যেকোনো বয়সের মানুষ শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারে। নিষ্ক্রিয় জীবনাচারের ফলে দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বাড়ছে। এর মধ্যে হূদরোগ, ক্যান্সার ও টাইপ-২ ডায়াবেটিস অন্যতম। সব অঞ্চল ও পেশার মানুষের জন্য সমানভাবে কায়িক শ্রমের সুযোগ না থাকলেও সাইকেল চালানো, খাওয়ার পর অন্তত আধা ঘণ্টা হাঁটার সুযোগ অধিকাংশেরই রয়েছে। এ অভ্যাস গড়ে তোলা গুরুত্বপূর্ণ।
মানবদেহের যেকোনো অংশে অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক কোষ বৃদ্ধিতে সৃষ্টি হয় ক্যান্সার। টিউমার হলো কোষের এক অস্বাভাবিক রূপ। রক্তের ক্যান্সার বাদে সব ক্যান্সার কঠিন টিউমারের কারণে হয়ে থাকে। হতে পারে হাড়, পেশি বা যেকোনো অঙ্গে। চিকিৎসকরা ক্যান্সারকে দুই ভাগে ভাগ করেছেন—কঠিন টিউমারের ফলে ক্যান্সার ও রক্তের ক্যান্সার।
সম্প্রতি সর্বোচ্চ পর্যায়ের (টারশিয়ারি বা বিশেষায়িত) সরকারি হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্তদের ওপর একটি গবেষণা পরিচালিত হয়। এতে দেখা যায়, কঠিন টিউমারের কারণে ক্যান্সার আক্রান্তদের ৫১ শতাংশই নিষ্ক্রিয় জীবনাচারে অভ্যস্ত। রোগীদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ পুরুষ ও ৪১ শতাংশ নারী। পেশাভিত্তিক বিভাজনে ৩৩ শতাংশই গৃহিণী। বাকিদের মধ্যে ১৭ শতাংশ চাকরিজীবী, ১৬ শতাংশ কৃষিজীবী, ২২ শতাংশ ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত ১১ শতাংশ রোগী। ক্যান্সারের ধরন বিবেচনায় ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত ১৯ শতাংশ, ১৪ শতাংশ লিম্ফোমা ক্যান্সার, ২৯ শতাংশ স্তন ক্যান্সার, ৭ শতাংশ করে ১৪ শতাংশের ক্ষেত্রে কোলোরেক্টাল (পায়ুপথ, বৃহদন্ত্রের ক্যান্সার) ও লিভার ক্যান্সার। এছাড়া খাদ্যনালি, গ্যাস্ট্রিক, মুখগহ্বর, জরায়ু, ডিম্বাশয় ও প্রোস্টেট ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ক্যান্সার রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল কিউরিয়াস গত মাসে ‘ক্লিনিকোপ্যাথলজিক্যাল প্যাটার্নস অব ম্যালিগন্যান্ট সলিড টিউমার ইন অ্যাডাল্ট পেশেন্ট: আ হসপিটাল বেজড স্টাডি ফ্রম বাংলাদেশ’ শিরোনামের গবেষণা প্রকাশ করে। গবেষণাটি করেছেন বাংলাদেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ১০ জন গবেষক।
গবেষকরা বলছেন, ক্যান্সার বা কঠিন টিউমার যে নির্দিষ্ট এক শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যে বেশি তা বলা কঠিন। নারীদের মধ্যে ক্যান্সারের হার বেশি পাওয়া য়ায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্তন ক্যান্সার। ঘরে-বাইরে যারা দীর্ঘ সময় বসে থাকার সুযোগ পান বা বসে কাজ করেন তাদের মূলত কায়িক পরিশ্রম করার সুযোগ কম। ১০ গবেষকের একজন ডা. এস কে জাকারিয়া বিন সাঈদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যারা শারীরিক পরিশ্রম কম করেন তাদের মধ্যে ক্যান্সারের হার বেশি।’
গবেষক দলের অন্যতম ডা. আয়শা সিদ্দিকা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্যান্সার হচ্ছে কঠিন টিউমার। এটা যেকোনো অঙ্গে হতে পারে। নিষ্ক্রিয় জীবনাচারে অভ্যস্তদের মধ্যে এ টিউমার বেশি দেখা গেছে। রক্তের ক্যান্সার বাদে অন্যান্য ক্যান্সার কঠিন টিউমারের কারণে হয়। উন্নত দেশগুলোয় ক্যান্সারের প্রথম পর্যায়েই চিকিৎসা শুরু করা যায়। আমাদের দেশে শেষ পর্যায়ে এসে ক্যান্সার শনাক্ত ও চিকিৎসা শুরু হয়। ফলে অনেক রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। স্তন ও জরায়ু ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ক্যান্সারের সঙ্গে নিষ্ক্রিয় জীবনাচারের সম্পর্ক গভীর।’
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে প্রকাশিত অন্য এক গবেষণা বলছে, নিয়ন্ত্রিত জীবনাচারের মাধ্যমে অন্তত ৩০-৪০ শতাংশ ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। শারীরিক কার্যকলাপে নিষ্ক্রিয়তা, টেবিল ওয়ার্ক ও স্থূলতা ক্যান্সারের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শারীরিক ক্রিয়াকলাপ থেকে বিরত থাকার ফলে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার বাড়তে দেখা গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, বছরে বিশ্বে ২০ লাখ মানুষ শারীরিক নিষ্ক্রিয়তার কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। নিষ্ক্রিয় জীবনাচারে অসংক্রামক রোগের কারণে মৃত্যুর হার বাড়ে। বিশেষ করে ক্যান্সার, হূদরোগ, ডায়াবেটিস ও স্থূলতা বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট পর্যন্ত মাঝারি শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিসম্মত খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্যান্সারের অনেক কারণ রয়েছে। রক্তের ক্যান্সার বাদে বাকি সব ক্যান্সার কঠিন টিউমারের কারণে হয়। ক্যান্সার আর সলিড টিউমার একই। তবে প্রতিটি অঙ্গের টিউমারের আলাদা নাম রয়েছে। এসবের ভিন্ন কারণ রয়েছে। নিষ্ক্রিয় জীবনাচারের কারণে অন্যান্য রোগ বেশি প্রভাবিত হয়। নিষ্ক্রিয় জীবনাচারের সঙ্গে স্থূলতার সম্পর্ক রয়েছে। আর স্থূলতা কয়েকটি কান্সারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। ক্যান্সার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জেনেটিক বা বংশগত। কিছু ক্ষেত্রে ধূমপান, ভেজাল খাবার ও পরিবেশ দূষণ ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়।’
গৃহিণীদের মধ্যে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বেশি বলে জানিয়েছে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল (এনআইসিআরএইচ)। প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি যে ক্যান্সার রেজিস্ট্রি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, প্রতি বছর হাসপাতালটিতে যত রোগী ক্যান্সার আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক গৃহিণী।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দুই দশকে বেড়েছে নগরায়ণের পরিসর। বেড়েছে প্রযুক্তির ব্যবহার। মানুষের মধ্যে প্রক্রিয়াজাত ও অতিপ্রক্রিয়াজাত (প্রসেসড ও আল্ট্রাপ্রসেসড ফুড) খাবারে নির্ভরশীলতা বেড়েছে। কমেছে কায়িক শ্রম। গৃহিণীদের মধ্যেও শারীরিক পরিশ্রম আগের মতো নেই। ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, স্থূলতাসহ অসংক্রামক ও দীর্ঘমেয়াদি বিভিন্ন রোগ বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনাচারের কারণে ক্যান্সারও প্রভাবিত হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্যান্সারের টিউমার শনাক্ত হওয়ার হার গত কয়েক দশকে বেড়েছে কিনা তা দেখতে হবে। আগে দেশের জনসংখ্যা কম ছিল, এখন বেশি। টিউমার জনসংখ্যা অনুপাতে বৃদ্ধি পেতে পারে। বংশগত কারণে ক্যান্সার বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া পরিবেশ বলতে মাটি, পানি বা বাতাসে ক্যান্সার হওয়ার উপাদান থাকলে ক্যান্সার হতে পারে। পেশাগত কারণেও ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়তে পারে। নিষ্ক্রিয় জীবনাচার বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ বৃদ্ধি করছে। তবে ক্যান্সারকে কতটুকু প্রভাবিত করছে তা বুঝতে হলে বিস্তর গবেষণা করতে হবে।’