দেশের প্রাথমিক থেকে বিশেষায়িত (টারশিয়ারি) সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মক্ষেত্রে অর্ধেক চিকিৎসকই অনুপস্থিত থাকেন। সময়মতো কর্মস্থলে উপস্থিত না থাকায় একদিকে বিলম্বিত হচ্ছে চিকিৎসা, পাশাপাশি সেবাপ্রার্থীরা পড়ছে ভোগান্তিতে। এতে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থার সংকট বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ থাকার পরও শুধু চিকিৎসকের অনুপস্থিতি স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে জরুরি বিভাগ ও আন্তঃবিভাগের রোগীদের চিকিৎসা বাদে বহির্বিভাগের কর্মসময় সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত। এ ৭ ঘণ্টাকে সরকারি সব পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত সময় হিসেবে ধরা হয়। বহির্বিভাগের চিকিৎসা, কনসালটেশন, রোগ নিরীক্ষাসহ বিভিন্ন কাজ হয় এ সময়ে। তবে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের উপস্থিতির হার অর্ধেকেরও কম।
নড়াইল জেলা হাসপাতালে সকাল ৯টার আগে চিকিৎসক পাননি বলে অভিযোগ করেন এক সেবাপ্রত্যাশী। সেলফোনের খুদেবার্তার মাধ্যমে অভিযোগটি গতকাল এসেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বা ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের নির্ধারিত ওয়েবে। একইভাবে গত ১২ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টায় নির্ধারিত চিকিৎসক পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ আসে জয়পুরহাট জেলা হাসপাতাল থেকে। কক্সবাজারের রামু ও পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বহির্বিভাগে চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করা হয় একই দিনে। শুধু সেবাগ্রহীতার মাধ্যমে নয়, চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির বিষয়টি জানা গেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজিটাল হাজিরা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেও।
সরকারের এ সংস্থার ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মোট চিকিৎসকের অর্ধেকের বেশি অনুপস্থিত থাকেন। ডিজিটাল হাজিরায় গত দুই মাসের তথ্য বিশ্লেষণে এ চিত্র পাওয়া যায়। এতে সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, আট বিভাগে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর ও জেনারেল হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বিশেষায়িত সরকারি হাসপাতালে কর্মরত ৩৪ হাজার চিকিৎসকের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হয়েছেন প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার। বাকি পৌনে ২১ হাজার নির্ধারিত সময়ে হাসপাতালে উপস্থিত হননি। শতকরা হিসাবে অনুপস্থিতি ৬১ শতাংশ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গতকাল সর্বোচ্চ উপস্থিতি ছিল ময়মনসিংহ বিভাগে, ৪৪ শতাংশ। এরপর সিলেটে ৪৩ দশমিক ৬১, চট্টগ্রামে ৪২, রাজশাহীতে ৪০, ঢাকায় ২৮, খুলনায় ৩৬, বরিশাল ও রংপুর বিভাগে ৩৫ শতাংশ করে চিকিৎসক কর্মক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হন।
জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদরা বলছেন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ থাকার পরও শুধু চিকিৎসকের অনুপস্থিতি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বাইরে জেলা-উপজেলায় সরকারি চিকিৎসকের অনুপস্থিতির হার তুলনামূলক বেশি। দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো অনুপস্থিতির বিষয়টিকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্থানীয় দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও কাজের অতিরিক্ত চাপ, কর্মজীবনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা চিকিৎসকের অনুপস্থিত থাকার বিষয়কে প্রভাবিত করে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের (এমআইএস) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. মো. শাহাদাত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের উপস্থিতির হার প্রায় ৮০ শতাংশ। যে তথ্যের কথা বলা হয়েছে সেটি সঠিক নয়।’
চিকিৎসকের উপস্থিতির হারে প্রায়ই পিছিয়ে থাকে বরিশাল, রংপুর ও খুলনা বিভাগ। রাজধানীতেও উপস্থিতির হার ৪০ শতাংশ বলে জানা যায় তিন বছর আগের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক অভিযানে। সারা দেশে ১১টি সরকারি হাসপাতালে অভিযান চালিয়ে সে সময় অনুপস্থিতির এ চিত্র দেখতে পায় সংস্থাটি। দুদক জানিয়েছিল, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা সরকারি কর্মঘণ্টার মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বসে রোগী দেখছেন।
কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মো. সাইদুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দেশের সরকারি হাসপাতালে ডিজিটাল হাজিরা নেয়া হয়। এ হাজিরা পর্যবেক্ষণের আলোকে অনুপস্থিতি বা স্বাস্থ্যসেবার অন্য বিষয়ে অভিযোগ এলে তা আমলে নিয়ে নিষ্পত্তি করা হয়।’
গত মার্চে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রকাশিত ‘হেলথ বুলেটিন ২০২০’ বলছে, সরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণকারীদের সুবিধার্থে ২০১২ সাল থেকে সেলফোনের খুদেবার্তায় (এসএমএস) অভিযোগ নেয়া শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সরকারের এ ব্যবস্থাপনায় ৭৩৯টি সরকারি হাসপাতাল ও সংস্থা যুক্ত রয়েছে। এসএমএস করে সেবাগ্রহীতারা যেসব অভিযোগ করে তার মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অনুপস্থিতি অন্যতম। ২০১৪-১৯ সাল পর্যন্ত ২৪ হাজার অভিযোগ, পরামর্শ ও ইতিবাচক মন্তব্য গ্রহণ করেছে এমআইএস। এর মধ্যে ৩২ শতাংশই হচ্ছে চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের অনুপস্থিতির বিষয়টি।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও বাংলাদেশের ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ ‘হয়্যার আর দ্য ডক্টরস? আ স্টাডি অ্যাবসেনটিজম অ্যামাং ডক্টর ইন রুরাল বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি দুর্নীতির একটি সাধারণ রূপ। এর প্রধান কারণ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনায় কর্মীর ঘাটতি ও অন্যান্য চিকিৎসা উপকরণের সংকট। দেশে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির হার ৩৫ শতাংশ।
গবেষণায় ছয়টি কারণে চিকিৎসকের অনুপস্থিতি প্রভাবিত হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কর্মক্ষেত্রের অনুপযুক্ত পরিবেশ, অনুপযুক্ত স্বাস্থ্য অবকাঠামো, যানবাহন না থাকা, চিকিৎসকের নিরাপত্তার অভাব, অতিরিক্ত কাজের চাপ ও উপকরণের অপর্যাপ্ততা। পাশাপাশি রয়েছে পেশাগত উত্কর্ষের জন্য উচ্চতর ডিগ্রিতে প্রস্তুতি সুবিধার অভাব, পদোন্নতি ও বদলির জটিলতা। এছাড়া লিঙ্গবৈষম্য, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে সেবাদাতার সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়ার জটিলতা, নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা, শাস্তিমূলক ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা ও ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে।
তবে চিকিৎসকের উপস্থিতির বিষয়টি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত প্রকাশ করেন মাঠ পর্যায়ের অনেক চিকিৎসক। তারা বলছেন, চিকিৎসকের অনুপস্থিতির হার এত বেশি হবে না। অনুপস্থিতির হার দিন দিন কমে এসেছে। বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মো. হুমায়ুন শাহীন খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা যখন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শনে যাই তখন এত অনুপস্থিতি পাই না। এখানে ডিজিটাল হাজিরার ডাটাবেজে তথ্যের বিভ্রাট থাকতে পারে। চিকিৎসকরা বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণে যান, অফিসের কাজে বিভিন্ন জায়গায় যান। তাই হাজিরায় এমনটা হতে পারে। উপজেলা বা জেলায় এখন চিকিৎসকরা মোটামুটি উপস্থিত থাকেন। সকাল ৮টায় হয়তো কেউ কেউ হাসপাতালে বসতে পারেন না। ১ ঘণ্টা দেরি হতে পারে। তবে জরুরি বিভাগে কখনো চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন না।’
বিভাগীয় এ পরিচালক জানান, দেশে সাত বিভাগের মতো বরিশাল বিভাগেও চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত অন্য কর্মীদের ঘাটতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ না হওয়ায় অনেক পদ শূন্য পড়ে আছে। এ বিভাগে প্রায় তিন হাজার চিকিৎসকের পদ রয়েছে। তবে এর অনুকূলে রয়েছেন মাত্র ৫০ শতাংশ চিকিৎসক।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় ধরনের প্রমাণসাপেক্ষে জরিপ না হলে কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকের অনুপস্থিতির বিষয়টি বলা যাবে না। সরকারি হাসপাতালে সক্ষমতার বেশি রোগী চিকিৎসা নেয়। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী ও অন্যান্য জনবলের সংকট রয়েছে। একই সঙ্গে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় যন্ত্রাংশসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য বিষয়েরও ঘাটতি রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. শাহ মনির হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চিকিৎসকের কাজের চাপ এত বেশি যে একজন রোগীর অপেক্ষাকাল দীর্ঘ হয়ে যায়। যার জন্য সেবাপ্রত্যাশীরা মনে করেন, তারা চিকিৎসককে পাচ্ছেন না। বহির্বিভাগে চিকিৎসকরা সাধারণত যথাসময়েই উপস্থিত হন। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে বহির্বিভাগে সক্ষমতার কয়েক গুণ রোগী আসে। সেজন্য রোগীকে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা সঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হন না, বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা দেরি করেন। তবে সবাই যে এমন করেন তা বলা যাবে না। বেসরকারি বা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে চিকিৎসকদের অনেকে শ্রম দেন। স্বাভাবিকভাবেই এতে সরকারি কর্মক্ষেত্রে ঘাটতি হয়ে যায়।’
স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা আরো পরিশীলিত হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ হলে তাদের শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। সরকারি বেতন নিয়ে কেউ সঠিক সময়ে কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হবেন না, অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন, তা হতে দেয়া যাবে না। আমরা বারবার বলে এসেছি, সমস্যার সমাধান করার উত্তম পন্থা হলো একটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে তার বাস্তবায়ন করা। এ বিষয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি।’