নিয়ম মানছে না আশিয়ান মেডিকেল কলেজ: ফাঁকা হাসপাতালে দেখানো হয় সাজানো রোগী

এক দশক আগে চিকিৎসা মহাবিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা করে বেসরকারি আশিয়ান মেডিকেল কলেজ। তবে আইন অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না বলে প্রমাণ পেয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। ঘাটতি রয়েছে কলেজটির হাসপাতালের বিশেষায়িত সেবায়। রোগী ভর্তির হার ৫ শতাংশেরও কম। শিক্ষাবর্ষ নবায়নের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি কর্তৃপক্ষ পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পেয়েছে, হাসপাতালে প্রকৃত রোগীর পরিবর্তে কর্মচারীদের রোগী সাজিয়ে রাখা হয়। শয্যার ঘাটতি, রোগী ভর্তির হার ও শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত শর্ত না মানায় সর্বশেষ শিক্ষাবর্ষের আসন বৃদ্ধির আবেদনে অনুমোদন পায়নি কলেজটি।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকার খিলক্ষেতে স্থাপিত আশিয়ান মেডিকেল কলেজকে ২০১২ সালে শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়। সে শিক্ষাবর্ষে ৫০ শিক্ষার্থীকে ব্যাচেলব অব মেডিসিন, ব্যাচেলর অব সার্জারি (এমবিবিএস) ডিগ্রিতে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে শিক্ষার্থী সংখ্যা আড়াই শতাধিক।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজ আইন, ২০২২ কার্যকর করে সরকার। আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার আগে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো ‘বেসরকারি মেডিকেল কলেজ স্থাপন ও পরিচালনা নীতিমালা ২০১১ (সংশোধিত)’ অনুযায়ী পরিচালনার বাধ্যবাধকতা ছিল। তবে আইন কার্যকর হওয়ার আগেও নীতিমালা মানেনি আশিয়ান মেডিকেল কলেজ।

শিক্ষকদের বেতন পরিশোধ অনিয়মিত বলে মেডিকেল কলেজসংশ্লিষ্টদের অভিযোগ রয়েছে। এমনকি বেতন পরিশোধের ব্যাংক স্টেটমেন্টও নিয়মিত নয় বলে জানান তারা। আইনে উল্লেখিত শিক্ষার্থী অনুপাতে হাসপাতালে যে-সংখ্যক শয্যা থাকার কথা, তাতেও রয়েছে ঘাটতি।

আইন অনুযায়ী ৫০ শিক্ষার্থীর আসনবিশিষ্ট বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৭০ শতাংশ বেড অকুপেন্সি রেট (শয্যায় রোগী ভর্তির হার) থাকতে হবে। ওই সংখ্যক শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে হাসপাতাল হতে হবে ২৫০ শয্যার। তবে আশিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯০ শয্যার ঘাটতি রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর।

নিয়ম অনুযায়ী, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর, অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি কলেজগুলোয় নিয়মিত পরিদর্শন করে। পরিদর্শন শেষে শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম অনুমোদনের সুপারিশ করে। তাদের তৈরি প্রতিবেদন পাঠানো হয় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগে। আশিয়ান মেডিকেল কলেজে সর্বশেষ পরিদর্শন করা হয় গত বছরের জুনে। পরিদর্শন শেষে তৈরি করা প্রতিবেদন অনুযায়ী, নীতিমালার (২০২২ সালে আইন কার্যকর করার আগে নীতিমালা অনুযায়ী পরিচালনা করার বিধান রয়েছে) বেশ কয়েকটি শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয় কলেজটি।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, একাডেমিক কার্যক্রমের জন্য নির্ধারিত ফ্লোর স্পেসের চেয়ে ২৫ হাজার বর্গফুটের ঘাটতি রয়েছে এ কলেজে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) অধিভুক্তির হালনাগাদ নিয়মিত নয়। বিধি মোতাবেক হয়নি বিভিন্ন বিভাগে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকের নিয়োগ। অধিকাংশ শিক্ষক স্বল্প সময়ে নিয়োগ দেয়া, যা কলেজের পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে হয়নি। নেই অ্যানেসথেসিয়া ও সাইকিয়াট্রির শিক্ষক। হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। নির্ধারিত বেড অকুপেন্সি রেটের চেয়ে ঘাটতির পরিমাণ ৬৫ শতাংশ। সাজানো রোগী ও হাসপাতালের কর্মচারীদের রোগী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। বেতনের শিট ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট পায়নি পরিদর্শন কমিটি। এসব কারণ উল্লেখ করে চলতি শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীদের ভর্তির জন্য আসন বৃদ্ধির কোনো সুপারিশ করেনি ওই কমিটি।

গত সপ্তাহে আশিয়ান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতলবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনের অভ্যর্থনা কক্ষের পাশেই জরুরি বিভাগ। গত বৃহস্পতিবার দিনের পুরো সময়ে ওই বিভাগে কোনো চিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। দেখা যায়নি জরুরি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম। নিচতলায় রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগ, সিটি স্ক্যান, আল্ট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রে, কিডনি বিভাগ, ডায়ালাইসিসি ইউনিট, নাক-কান-গলা, ডেন্টাল, চক্ষু বিভাগ, জরুরি অপারেশন থিয়েটারের সাইনবোর্ড চোখে পড়ে। তবে এসব বিভাগে দেখা যায়নি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগীর উপস্থিতি। শুধু গাইনি ও নবজাতক বিভাগে কয়েকজন রোগীকে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়। তালাবদ্ধ ছিল এনআইসিইউ (নবজাতক নিবিড় যত্ন ইউনিট) ওয়ার্ড।

দ্বিতীয় তলায় কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যানের কক্ষের পাশে মেডিসিন পুরুষ ও নারী ওয়ার্ড এবং সার্জারি পুরুষ ও নারী ওয়ার্ডে যথেষ্ট শয্যা থাকলেও ছিল না কোনো রোগী। এর ঠিক পাশের অর্থোপেডিক ও ফিজিওথেরাপি ওয়ার্ডের অবস্থাও প্রায় একই রকম। এ ফ্লোরে প্যাথলজি, আইসিইউসহ হাসপাতাল প্রশাসন ও চিকিৎসকদের কক্ষ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কলেজে নিয়মিত শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও চিকিৎসার জন্য বেশি রোগী হাসপাতালে আসে না। চিকিৎসাসেবার মান ও সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালের ফার্মেসি ব্যতীত কলেজ ক্যাম্পাসের কাছাকাছি কোনো ফার্মেসি নেই।

এ হাসপাতালের সাবেক এক পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা কলেজের হাসপাতালটিকে স্বাস্থ্যসেবার আদর্শ একটি প্রতিষ্ঠান করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। শিক্ষক ও চিকিৎসকদের বেতন অনিয়মিত। কেউ বকেয়া বেতন দাবি করলে তাকে আটকে রেখে নির্যাতন করারও ঘটনা রয়েছে। চেয়ারম্যানের ব্যবহার ভালো নয়। চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। কলেজের শিক্ষা ও হাসপাতালে সেবা মানসম্মত নয়। রোগী ভর্তি ১০-২০ জনের মধ্যে থাকে। অনেক চিকিৎসক ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলাও দেয়া হয়েছে।’

চিকিৎসা শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে যেসব শর্ত মানার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তার প্রতিপালন হতে দেখা যায় না। মেডিকেল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অধিভুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং বিএমডিসির প্রয়োজনীয় আইনের বাস্তবায়ন দেখার কথা। এ তিন কর্তৃপক্ষ যদি নিয়ম অনুযায়ী কাজ করে তবে কোনো মেডিকেল কলেজ শর্ত না মেনে একাডেমিক ও হাসপাতালের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে না। শর্ত না মানলে ওইসব কলেজকে নির্দিষ্ট সময় দেয়া হয়। এর পরও কলেজ কর্তৃপক্ষ সাড়া না দিলে তা বন্ধ করে দিতে হবে।

কলেজের হাসপাতালে সাজানো রোগী দেখানো হলে তা গুরুতর অপরাধ বলে মন্তব্য করেছেন ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেডিকেল এডুকেশনের (ডব্লিউএফএমই) সাবেক জ্যেষ্ঠ পরামর্শক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মেডিকেল কলেজগুলো যখন পরিদর্শনে যাওয়া হয় তখন সাজানো রোগী দেখানোর কথা শোনা যায়। এ সংস্কৃতি প্রায় এক যুগ ধরে চলে আসছে। এটা অপরাধ। মেডিকেল কাউন্সিল এর জন্য ওই কলেজ বন্ধ করার সুপারিশ করতে পারে। মেডিকেল কলেজগুলোকে যেসব শর্ত মানতে হবে তার বেশির ভাগই প্রতিপালন হচ্ছে না। এতে শিক্ষার্থীরা সঠিক প্রশিক্ষণ পাচ্ছে না। ন্যূনতম যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তা না থাকার কারণে ভবিষ্যতে তাদের হাতে রোগীর স্বাস্থ্যনিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। যেহেতু মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থীরা পড়ে সেজন্য কোনো কলেজ আইন না মানলে সংশোধনের জন্য তাদের নির্দিষ্ট সময় দিতে হবে। এর পরও কেউ শর্তগুলো না মানলে সে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেবে মন্ত্রণালয়।’

এ বিশেষজ্ঞের মতে, দেশে চিকিৎসা শিক্ষার মান নিম্ন অবস্থায় রয়েছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার মানও নিম্নমুখী। ফলে নতুন চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ যথাযথ হচ্ছে না। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রি নেয়া চিকিৎসকের হাতে স্বাস্থ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।

স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বিষয়ে সতর্ক রয়েছি। তারা আইনের শর্তগুলো মানছে কিনা সে বিষয়ে কাজ করছি। যারা আইন মানছে না তাদের সতর্ক করা হয়েছে। শুধু আমরাই না, বিএমডিসি, সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে। পরে সুপারিশ অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়। আইন না মানার বিষয়গুলো খুঁজে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েকটি মেডিকেল কলেজ বন্ধের পথে। যেসব মেডিকেল কলেজের ত্রুটি রয়েছে, সেগুলোও দেখা হচ্ছে। আমরা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে কাজ করছি।’

নিয়ম না মানার বিষয়ে মন্তব্য জানতে আশিয়ান মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মেজর জেনারেল (অব.) ডা. মো. মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

অনিয়মের বিষয়ে আশিয়ান মেডিকেল কলেজের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের কলেজে কোনো ঘাটতি নেই। হাসপাতালেও কোনো ধরনের সংকট নেই। বরং আমরা বহু মানুষকে বিনামূল্যে ভালো চিকিৎসা দিই। শিক্ষক ও চিকিৎসক প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই রয়েছে। কলেজ ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করা হচ্ছে তা সত্য নয়।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: