মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতাল: প্রসূতি স্বাস্থ্য ও সড়কে আহতদের সেবায় ভরসার প্রতিষ্ঠান

সারা দেশে প্রায় প্রতিদিনই সড়ক-মহাসড়কে প্রাণ হারায় মানুষ। গুরুতর আহতের সংখ্যাও কম নয়। কোনো কোনো এলাকার সড়ক বেশি দুর্ঘটনাপ্রবণ। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বাইরে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য বিশেষায়িত সেবার সুযোগ কম। এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতাল। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা-কক্সবাজার সড়কে আহতদের সেবা দিতে নিবেদিতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারির পাশাপাশি প্রসূতি ও স্ত্রী রোগের সেবায়ও এরই মধ্যে বেশ পরিচিতি পেয়েছে হাসপাতালটি। কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাট স্টেশনের পশ্চিম পাশে এ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান।

স্বাধীনতার আগে কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দাদের উন্নত চিকিৎসা প্রাপ্তির সুযোগ ছিল কম। বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল অত্যধিক। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাসেবার অপ্রতুলতার কারণে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামে পাড়ি জমাত। বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতদের জন্য তাত্ক্ষণিক উন্নত চিকিৎসার অপ্রতুলতা ছিল এ অঞ্চলে। তবে এ সংকট কমাতে এগিয়ে আসে মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতাল। বছরের পর বছর ধরে অব্যাহত চেষ্টা আর আন্তরিকতায় সেবা দিয়ে মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

হাসপাতালটির প্রতিষ্ঠাতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত চিকিৎসক ও ‘ডাক্তার: ডিপ্লোম্যাট ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের লেখক ডা. ভিগো বি আলসেন। ১৯৬৬ সালে মাত্র পাঁচজন মার্কিন চিকিৎসকের প্রচেষ্টায় এটি গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে পুরনো ভবনের পাশাপাশি নতুন আধুনিক ভবনে চলছে চিকিৎসাসেবার কার্যক্রম। খ্রিস্টান মিশনের মাধ্যমে পরিচালিত হাসপাতালটি প্রথমদিকে বনের জমি ইজারা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। পরবর্তী সময়ে ২৫ একর জমি দেয় সরকার। এ জমিতে নির্মাণ করা হয়েছে হাসপাতালের আধুনিক ভবন, বিদেশীদের জন্য আবাসিক এলাকা, খেলার মাঠ, একটি উন্মুক্ত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৯৫৭-৫৮ সালে চকরিয়া উপজেলার বমু বিলছড়ি ইউনিয়নে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঁচ সদস্যের একটি চিকিৎসক দল। ওই সময় ১৭ বছর বয়সী স্থানীয় এক কিশোরী অ্যাপেন্ডিক্সের সংক্রমণে মারা যায়। ঘটনাটি ওই চিকিৎসকদের মনে নাড়া দেয়। তারা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে গিয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাপ্টিস্টস ফর ওয়ার্ল্ড এভানজিউলিমের (এবিডব্লিউই) কাছে কক্সবাজারে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেন। বর্তমানে হাসপাতালটি ৫০ শয্যা নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।

এবিডব্লিউইর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৬ সাল থেকে এটি অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাপ্টিস্টের মেডিকেল ক্যাম্প হিসেবে কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবিক সাহায্য সংস্থা সামারিটার্নস পরসে ১৯৮১ সাল থেকে এখানে স্বেচ্ছাসেবক সার্জন পাঠাচ্ছে। ২০১৩ সালে নতুন ভবনে রোগীর ক্ষমতা তিন গুণ বৃদ্ধি পায়। একই সঙ্গে অস্ত্রোপচারের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত অস্ত্রোপচার ও ডায়াগনস্টিক সরঞ্জাম থাকায় রোগীরা পাচ্ছেন টেস্টের যাবতীয় সুবিধাও। গুরুতর রোগীদের পরিবহনের জন্য ভবনের ছাদে রয়েছে হেলিপ্যাড। সম্প্রতি হাসপাতালের অবকাঠামো ১ লাখ ২০ হাজার বর্গফুটে উন্নীত করা হয়েছে।

হাসপাতালটিতে রয়েছে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতিসমৃদ্ধ আধুনিক ৯টি অস্ত্রোপচার কক্ষ (অপারেশন থিয়েটার), অত্যাধুনিক রোগ নিরীক্ষাগার (ডায়াগনস্টিক ল্যাব), প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা, রেডিওলজি পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান ও ফিজিওথেরাপি। হাসপাতালের সার্বিক চিকিৎসাসেবা ও সুবিধায় প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বমানের বলে দাবি করেছে এর কর্তৃপক্ষ।

বর্তমানে ১৫টি বিভাগে পাঁচজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। এর মধ্যে ভাস্কুলার, অ্যানেস্থেসিওলজি, অর্থোপেডিক, মেডিসিনে একজন করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক উচ্চতর ডিগ্রির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। অন্যান্য লোকবলের মধ্যে ৪০ জন নার্স এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন আরো ৩৭০ জন। রোগীদের পর্যাপ্ত সেবাদানে হাসপাতালটি আদর্শ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি পেয়েছে। বিশেষত অর্থোপেডিক সার্জারি ও প্রসূতির সেবাদানই হাসপাতালটির বিশেষত্ব। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, হাসপাতালটিতে বছরে ৩০-৩৫ হাজার মানুষ চিকিৎসাসেবা নিচ্ছে। আর অস্ত্রোপচার হচ্ছে প্রায় দেড় সহস্রাধিক। স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ মাহবুব জানিয়েছেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামের লাখো মানুষের উন্নত চিকিৎসার ভরসাস্থল এ হাসপাতাল।

হাসপাতালের সহকারী হেড অব অপারেশন যোসেপ অমূল্য রয় বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমেরিকার অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাপ্টিস্টসের সার্বিক তত্ত্বাবধানে হাসপাতালটি পরিচালিত হচ্ছে। এটি শুধু আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালই নয়, উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিসহ রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধারও ব্যবস্থা রয়েছে। স্বল্প ব্যয়ে হাতের নাগালে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নেয়া যায়।’

তার মতে, হাসপাতালের জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক সার্জারি ও প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ চিকিৎসায় বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। নিরাপদ প্রসবের জন্য এলাকার মানুষের ভরসার জায়গা। হাসপাতালে রাতদিন ২৪ ঘণ্টা সেবা দেয়া এবং অস্ত্রোপচার করা হয়। আগে এখানে বিনামূল্যে সেবা দেয়া হলেও বর্তমানে খরচের কিছু অংশ সেবাগ্রহীতাদের থেকে নেয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারার সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন পঞ্চাশোর্ধ্ব সাধন দে। দুই মাস ধরে ভর্তি আছেন হাসপাতালে। এরই মধ্যে পা কেটে ফেলা হয়েছে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছেন তিনি। সেবার বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, ‘এ হাসপাতাল না থাকলে সুস্থ হওয়া কঠিন ছিল। দ্রুত সেবা পেয়েছি। অন্যথায় হয়তো দেশের বাইরেও যাওয়ার প্রয়োজন পড়ত।’

বান্দরবানের লামার দেড় বছর বয়সী শিশু আলিফের বাঁ পা জন্মগতভাবে বাঁকা। নিয়মিত চিকিৎসা চলছে এ হাসপাতালে। এখন অনেকটাই সুস্থ এ শিশু। ব্যায়ামের জন্য দেয়া হয়েছে কৃত্রিম পা। হাসপাতালের সেবা নিয়ে খুশি চকরিয়ার পালাকাটার উবাইদুল। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেক হাসপাতালে গেলেও সর্বশেষ এখানে এসে স্বল্প খরচে চিকিৎসা নিয়েছি।’

কর্তৃপক্ষ বলছে, প্রথমে আগত রোগীদের রেজিস্ট্রেশন করা হয়। এতে ফি রাখা হয় দুইশ টাকা। এ কার্ডের মাধ্যমে একজন রোগী টানা সাত বছর চিকিৎসাসেবা নিতে পারবেন। শতভাগ চিকিৎসক বিদেশী হওয়ায় এক্ষেত্রে একটি সংকট দেখা দিচ্ছে। স্থায়ীভাবে বসবাস করতে হয় বলে অনেকেই এখানে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। চিকিৎসা, নার্সিং, ব্যবস্থাপনা, যন্ত্রপাতি সংরক্ষণ, মেরামতসহ সব শাখার প্রধান বিদেশী। বাংলাদেশী চিকিৎসক নিয়োগ দেয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে আল্ট্রাসনোগ্রাফি, সিটি স্ক্যান ও হূদরোগ নিরীক্ষার ব্যবস্থা সংযোজন করা হবে।

উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১০-এর বাসিন্দা আসা আবুল ফয়েজ এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি জানান, টিভি টাওয়ার-সংলগ্ন এলাকায় বাসের ধাক্কায় পা দুটো ভেঙে যায়। এরপর হাসপাতালে দ্রুত অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসকরা। এতে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুজান এজ এখন হাসপাতালের প্রশাসক। এ হাসপাতালে এসেছিলেন ১৯৯০ সালে। মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালের বিশেষ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সুজান এজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘হাসপাতালের আমরা সবাই একটি পরিবারের মতো, বড় পরিবার। আমরা প্রত্যেকে বিশ্বস্ততার সঙ্গে কাজ করি। আমরা কেউ এখানে চাকরি করি না, আমরা এখানে মানুষের সেবা করি।’

কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে তা অবশ্যই প্রশংসনীয় বলে মন্তব্য করেন চট্টগ্রামের বিভাগীয় (স্বাস্থ্য) পরিচালক ডা. মো. মহিউদ্দিন। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে যোগদান করেছি। কক্সবাজারের মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালটি স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বলে শুনেছি। বিষয়টি প্রশংসনীয়।’

(প্রতিবেদনটিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বণিক বার্তার কক্সবাজার প্রতিনিধি ছৈয়দ আলম)

Source: Bonik Barta

Share the Post: