গাইনি ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞ হিসেবেই নিজেকে প্রচার করেন ডা. সংযুক্তা সাহা। নিজের পসার বাড়াতে বেছে নেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে, যেখানে এ চিকিৎসক তুলে ধরেন তার সফলতার গল্প। কখনো আবার রোগী ও তাদের স্বজনদের দিয়েও এসব গল্প বলান। এতে প্রভাবিত হয়ে রোগীরা তার কাছে ছুটে আসে। তবে এটাকে অনৈতিক ও চিকিৎসা নৈতিকতাবিরোধী বলে মনে করছেন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা। এর বাইরেও সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে চিকিৎসায় অবহেলা ও রোগীদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। এসব কারণে দুই বছর আগে একটি মেডিকেল কলেজ তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়। এমনকি তিনি মেয়াদোত্তীর্ণ নিবন্ধনে এক যুগের বেশি সময় ধরে চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) থেকে ২৩ বছর আগে ডা. সংযুক্ত সাহাকে চিকিৎসকের নিবন্ধন দেয়া হয়। ওই নিবন্ধন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে এক যুগ আগে, ২০১০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। এমনকি তিনি যেসব উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন তা বিএমডিসিতে জমা দেননি বলেও অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলাছেন, চিকিৎসকের নিবন্ধন নবায়ন না করে রোগীদের চিকিৎসা দেয়া চরম অনৈতিক।
সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় নবজাতকসহ প্রসূতির মৃত্যুর ঘটনায় আবারো আলোচনায় ডা. সংযুক্তা সাহা। ফেসবুকে তার প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে অস্ত্রোপচার ছাড়া প্রসব করাতে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে এসেছিলেন মাহবুবা রহমান আঁখি। কিন্তু এ চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে ওই হাসপাতালে প্রসব করাতে গিয়ে নবজাতকের মৃত্যু হয়, শেষে রোববার মারা যান আঁখিও। অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও ডা. সংযুক্তা সাহার অবহেলা ও প্রতারণার কারণেই মা ও সন্তানের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনার পর সংযুক্তা সাহা ওই হাসপাতালে আপাতত কোনো বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
এদিকে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে বুধবার ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন আঁখির স্বামী ইয়াকুব হোসেন। এতে আসামি করা হয় ডা. সংযুক্তা সাহা, হাসপাতালটির গাইনি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক, ব্যবস্থাপকসহ কয়েকজনকে। সেই মামলায় ডা. সংযুক্তা সাহার দুই সহযোগী ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহাকে ওইদিন রাতেই গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন তাদের আদালতে তোলা হলে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে সম্মত হন। জবানবন্দি রেকর্ড করে বিচারক এ দুই চিকিৎসককে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
চিকিৎসক সংযুক্তা সাহা চিকিৎসা নৈতিকতা লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২০ সালের নভেম্বরে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ থেকে চাকরিচ্যুত হন। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাহায্যে রোগীদের প্রভাবিত করে সেন্ট্রাল হাসপাতালে ভর্তি হতে উদ্বুদ্ধ করেন। যদিও সংযুক্তা সাহার চিকিৎসক নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০১০ সালে। এমনকি তিনি যেসব উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন বলে দাবি করেন, সেগুলোর সনদ বিএমডিসিতে জমা দেননি।
বিএমডিসি সূত্রে জানা যায়, ডা. সংযুক্তা সাহা এমবিবিএস চিকিৎসকের বিএমডিসি নিবন্ধন পান ২০০০ সালে। তার নিবন্ধন নম্বর এ-৩০০৯৭। তবে এর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে ২০১০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। মূলত এমবিবিএস ডিগ্রির ওপর নিবন্ধন দেয়া হলেও বিভিন্ন মেয়াদের পর সেটি নবায়ন করতে হয়। এ সময় ওই চিকিৎসক যদি বিশেষায়িত কোনো ডিগ্রি অর্জন করেন তাহলে তাকে তা বিএমডিসিকে অবহিত করে তার স্বীকৃতি নিতে হয়। তবে ডা. সংযুক্তা সাহা ২০১০ সালের পর আর নিবন্ধন নবায়ন করেননি।
জানতে চাইলে শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চিকিৎসক হিসেবে সংযুক্ত সাহা অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতেন। ফলে তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এর কিছুদিন আগে তিনি অধ্যাপক হন। রেজিস্ট্রেশন নম্বর দেয়া হয় এমবিবিএস ডিগ্রির ওপর। রিনিউ করলে ওই নম্বরই সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে দেয়া হবে। এর মধ্যে চিকিৎসক উচ্চতর ডিগ্রি নিলে সেসব সার্টিফিকেট বিএমডিসিতে জমা দিতে হয়। বিএমডিসি তা যাচাই করে স্বীকৃতি দেয়।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সংযুক্তা সাহা ১৯৯৯ সালে ইউএসটিসি (ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম) মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি অবস ও গাইনির ওপর এমএস (মাস্টার্স অব সার্জারি) অর্জন করেন। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে গাইনি চিকিৎসায় তার ডিপ্লোমা ও বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ রয়েছে। তবে তার এসব ডিগ্রি ও প্রশিক্ষণ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা।
বাংলাদেশের চিকিৎসকদের নিবন্ধন দেয় বিএমডিসি। কোনো চিকিৎসকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয় এ সংস্থা। বিএমডিসির ডিসিপ্লিনারি কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী। ডা. সংযুক্তা সাহার নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হলে কোনো ডাক্তারই চিকিৎসাসেবা দিতে পারেন না। এটা বেআইনি না হলেও অনৈতিক। তবে ডা. সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। মিডিয়ার মাধ্যমেই আমরা বিষয়টি জেনেছি। এটার জন্য আগামী শুক্রবার কমিটির সবাই বসব। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে এগুলোর বিষয়ে তার সঙ্গে কথা না বললে পরিষ্কার হওয়া যাবে না। আর চিকিৎসায় অবহেলার বিষয়টা ফৌজদারি বিষয়। আমরা কেবল নৈতিক বিষয়গুলো দেখি।’
সেন্ট্রাল হাসপাতাল ছাড়াও গ্রিন রোডের একটি ও উত্তরায় আরো একটি হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা নিয়মিত রোগী দেখছেন বলে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের ওয়েসবাইট থেকে জানা যায়। তবে ওয়েবসাইটে তথ্য থাকলেও সংযুক্তা সাহার রোগী দেখার বিষয়টি অস্বীকার করেছে একটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ওই হাসপাতালের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘ডা. সংযুক্তা সাহা উচ্চাভিলাষী ও অনৈতিক চিকিৎসক। তাকে আমরা রোগী দেখার সুযোগ দিইনি।’
এ বিষয়ে জানতে গত কয়েকদিন ডা. সংযুক্তা সাহার সঙ্গে বিভিন্নভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। শনিবার তার সেলফোনে কল করা হলে ওপাশ থেকে একজন তা রিসিভ করেন। তবে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর লাইন কেটে দেন। এরপর গত রবি ও সোমবার চেষ্টা করেও তার সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে ডা. সংযুক্তা সাহার মেয়াদোত্তীর্ণ নিবন্ধনের বিষয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালের ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এমএ কাশেম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তার নিবন্ধনের বিষয়টি আমরা যাচাই করিনি। কেননা তিনি এখানে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এটা সরকারি কর্তৃপক্ষের কাজ।’ চিকিৎসায় অবহেলা ও রোগীদের প্রতারিত করার অভিযোগের বিষয়ে অবশ্য তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
চিকিৎসকদের নিবন্ধনের বিষয়েও বিএমডিসির কিছু গাফিলতি রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের জাতীয় কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ-ই-মাহবুব। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একজন চিকিৎসকের রেজিস্ট্রেশন থাকাটা বাধ্যতামূলক। এমন অনেক চিকিৎসক আছেন যারা ওটা রিনিউ করান না। এটা বিএমডিসির একটা গাফিলতিও বলা যায়। কারণ তিনি যদি রিনিউ না করেন তার চিকিৎসা দেয়ার এখতিয়ারও তো নেই। আমার ধারণা বেশির ভাগ ডাক্তারেরই এটা নেই। সুতরাং এটা বিএমডিসির ব্যর্থতা। আমাদের ব্যর্থতা যে আমরা রিনিউ করাইনি। আবার যে হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসকরা কাজ করেন তাদেরও এটা যাচাই করার দায়িত্ব রয়েছে। কেননা যার রেজিস্ট্রেশন নেই তাকে চিকিৎসাসেবা দেয়ার অধিকার দেয়া হয়নি।’
চিকিৎসায় অবহেলার প্রতিকারের বিষয়ে এ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘চিকিৎসা করা কোনো ক্রিমিন্যাল অফেন্স নয়। সুতরাং চিকিৎসক কোনো ক্রিমিন্যাল নন। ফৌজদারি অপরাধের নির্দিষ্ট ধারা আছে। কোনো রোগী প্রতারিত হলে প্রথমত, যেখানে প্রতারিত হয়েছে সেই প্রতিষ্ঠানকে জানানো, কিংবা সরকারকে জানানো। এ বিষয়ে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ দিতে পারে অথবা হাসপাতলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দিতে পারে। আর নৈতিকতার বিষয়েও সরকারকে জানাতে পারে, বিএমডিসিকেও জানাতে পারে। কিন্তু এ প্রক্রিয়াগুলোয় সময় বেশি লাগে।’