দেশে মশাবাহিত রোগের প্রকোপ আবার বেড়েছে। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর কয়েকটি রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলেও সম্প্রতি একটি রোগ সারা দেশে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। মূলত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুর পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে দেশে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস বহনকারী মশার ঘনত্ব বেড়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মশা নির্মূল ব্যবস্থার দুর্বলতা। রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, দেশে পাঁচ-ছয়টি মশাবাহিত রোগ দেখা যায়। বর্তমানে জাপানিজ এনকেফালাইটিস, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়া ও জিকা রোগ দেখা যাচ্ছে। এর বাইরেও কিছু মশাবাহিত রোগ দেখা যাচ্ছে। দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে রোগ নিয়ন্ত্রণ করে মৃত্যু কমানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব মিলিয়ে মশাবাহিত এসব রোগের প্রাদুর্ভাব দেশের সার্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম উদ্বেগের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
আমেরিকান মসকিটো কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশন (এএমসিও) বলছে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ১০ লাখেরও বেশি মানুষ মশাবাহিত রোগে মারা যায়। মশা শুধু মানুষকে আক্রান্ত করে তা-ই না, বরং এমন কিছু ভাইরাস ও পরজীবী ছড়ায়, যা কুকুর বা ঘোড়ার জন্যও সংবেদনশীল।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মশাবাহিত ছয়টি রোগ রয়েছে। এগুলো হলো চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু, জিকা, ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া ও কালাজ্বর। এর মধ্যে চিকুনগুনিয়ায় ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু দেখা যায়। ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। এখন দেশের ১৩টি জেলায় ম্যালেরিয়া সংক্রমণের তথ্য মিললেও পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এ রোগে মৃত্যুও হচ্ছে। কালাজ্বর ও জিকাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। তবে পীতজ্বর দেশে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ওয়ার্ল্ড মসকিটো প্রোগ্রাম ও যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা স্বাস্থ্য বিভাগের মতে, বিশ্বে থাকা তিন সহস্রাধিক প্রজাতির মধ্যে প্রায় ১০০ প্রজাতির মশা অন্তত ২০টি প্রাণঘাতী রোগ ছড়াতে সক্ষম। বাংলাদেশে ঠিক কত প্রজাতির মশা রয়েছে তার গবেষণা না থাকলেও সংখ্যাটা অন্তত শতাধিক বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল এমডিপিআইয়ের ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায়। তবে বর্তমানে নতুন করে জাপানিজ এনকেফালাইটিস দেখা দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে পশ্চিম নীল ও জিকা রোগ দেশে প্রবেশ করেছে।
মূলত জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ, মানুষের গতিশীলতা বৃদ্ধি, অনুপযুক্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নিরক্ষরতা ও সচেতনতার অভাবের মতো বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণে বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) বলছে, জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী সুস্থতার ওপর একটি বড় প্রভাব ফেলবে এবং বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ নিম্নভূমির দেশগুলোয় খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ উল্লেখ করে সংস্থাটি বলছে, এর সঙ্গে সঙ্গে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, কালাজ্বর ও জাপানিজ এনকেফালাইটিস ভাইরাস সংক্রমণের মতো ভেক্টরবাহিত রোগের পরিধি বাড়তে পারে। আবহাওয়ার ধরন পরিবর্তনের ফলে রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর পরিবর্তন হতে পারে।
কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, নানা প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে দীর্ঘকাল ধরে মশা টিকে আছে। আগে এডিস মশা পরিষ্কার পানি ছাড়া ডিম পাড়ত না। কামড়াত শুধু সকালে ও সন্ধ্যায়। এখন এ মশা দূষিত ও নোংরা পানিতে জন্মাচ্ছে। রাত-দিন সবসময়ই কামড়াচ্ছে। শহরের বহু বাড়িতে দিনের বেলায় আলো যায় না আবার রাতের বেলায় অন্ধকার থাকে না। এমন আলোর দূষণে মশাও আচরণ বদলেছে। এমন পরিস্থিতিতে কীটনাশকও ঠিকভাবে কাজ করছে না। একইভাবে অ্যানোফিলিস মশাও তাদের ধরন পাল্টেছে। কালাজ্বর দেখা যাচ্ছে এখন। তাছাড়া রাজধানীতে যেসব এলাকায় ভবন নির্মাণ হচ্ছে তা যথাযথ নিয়ম মেনে হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন শহরে বহু জলাশয় রয়েছে, যেখানে মানবসৃষ্ট দূষণ হচ্ছে। ফলে মশার বংশবিস্তার প্রভাবিত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, দেশে মূলত এডিস মশা, অ্যানোফিলিস, কিউলেক্স মশা ও স্যান্ডফ্লাই নামে এক প্রকার মাছি ও মশার মাধ্যমে ছয়টি রোগ ছড়িয়েছে। এসব রোগের মধ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাস। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যেই গত কয়েক বছরে দেশে মারাত্মক রূপ নেয় ডেঙ্গু। সম্প্রতি সারা দেশে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে মশাবাহিত সংক্রামক এ রোগ। চলতি বছর বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৫ দশমিক ৪৫ জন। ইউরোপীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (ইসিডিসি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরিসংখ্যানে প্রকাশিত তথ্য বিশ্লেষণে এমন চিত্র পাওয়া যায়।
তবে এমন পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে সঠিকভাবে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না বলে মন্তব্য জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, ৬০ বছর আগে ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণে নেয়া পদক্ষেপ ফলপ্রসূ হয়েছিল। এ সময় ডেঙ্গু কেন ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা যাচ্ছে না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণেও ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বরের মতো ভিন্ন নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি নিতে হবে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি মশা নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োজন। তবে সরকারের কোনো বিভাগই বৈজ্ঞানিকভাবে কার্যক্রম করতে পারছে না। পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা এমনভাবে করতে হবে যেন মৃত্যু শূন্যে থাকে।
মশাবাহিত রোগ বিশেষ করে ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি রোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মৌসুমি সময় ছাড়াও আমরা ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছি। যে প্রক্রিয়ায় ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত সেভাবে বা সে প্রক্রিয়ায় কার্যক্রম হয়নি। শুধু কীটনাশক দিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’
দেশে প্রথম ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। এডিস মশার মাধ্যমে এ রোগের বিস্তার ঘটে। ২০১৭ সালে দেশে চিকুনগুনিয়া ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় অন্তত ৩০টি জেলায় এ রোগী পাওয়া যায়। গত মে মাসে প্রকাশিত এক তথ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু ছড়ায়। ২০০৭ থেকে ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে ৫ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ৬৫৭ জন। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার সর্বোচ্চ।
কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশা ফাইলেরিয়া রোগ ছড়াচ্ছে। দেশের অন্তত ৩৪টি জেলায় এ রোগ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রথম ১৯৭৭ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর বন এলাকায় জাপানিজ এনকেফালাইটিস আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে রাজশাহী, রংপুর, চট্টগ্রাম ও খুলনা অঞ্চলে রোগটি পাওয়া যায়। আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের মৃত্যু হয় বলে বৈশ্বিক বিভিন্ন জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশকে জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি।
নেদারল্যান্ডসের বৈজ্ঞানিক জার্নাল এলসেভিয়ার বলছে, বাংলাদেশে ১৯৯৩ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেড় লাখ কালাজ্বরের রোগী পাওয়া গেছে। পরবর্তী সময়ে জাতীয় কালাজ্বর নির্মূল কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। ২০১২ সালে সারা বিশ্বে যত কালাজ্বরের সংক্রমণ পাওয়া গেছে তার ৮০ শতাংশই ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশে এবং ২০১৫ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯ শতাংশে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মশাবাহিত গোদ রোগ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে ডব্লিউএইচও প্রত্যয়ন করেছে। কালাজ্বরও নিয়ন্ত্রণের পথে। তবে মাঝে মাঝে দেখা যাচ্ছে। ম্যালেরিয়া এখনো ১৩ জেলায় থেকে গেছে। পার্বত্য তিন জেলা বাদে বাকি জেলাগুলো নির্মূলের অবস্থায় চলে এসেছে। জাপানিজ এনকেফালাইটিস দেশের কয়েকটি অঞ্চলে রয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এডিসবাহিত জিকা, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু। গত ২৩ বছরে তা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। বাংলাদেশের জন্য ডেঙ্গু বিষফোঁড়া হয়ে রয়ে যাচ্ছে। অন্য কোনো রোগ এত পরিসরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকেনি। শুরুতে ঢাকায় এ রোগ থাকলেও এখন সারা দেশে পাওয়া যাচ্ছে। যদি রোগী কমানো না যায় তাহলে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়বে। রোগী কমাতে হলে মশা নির্মূলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া নিয়ে আমরা বেশি চিন্তিত। তবে ম্যালেরিয়া, জিকা, জাপানিজ এনকেফালাইটিস নিয়েও আমাদের কার্যক্রম রয়েছে। কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণেও কার্যক্রম রয়েছে। আমরা কোনো কোনো রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল করতে পেরেছি। বাকিগুলোও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে।’