জুলাইয়ের ২৫ দিন: ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে আড়াই গুণ দ্রুতগতিতে

বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল ৭ হাজার ৯৭৮ জন। অন্যদিকে চলতি জুলাই শেষ হতে এখনো পাঁচদিন বাকি। যদিও গতকাল পর্যন্ত মাসের প্রথম ২৫ দিনেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭১০ জনে। দীর্ঘদিন ধরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্র হিসেবে প্রধানত ঢাকা মহানগরীকে দেখা হলেও এখন রাজধানীর বাইরে রোগটি ছড়াচ্ছে তুলনামূলক দ্রুতগতিতে।

সরকারের দেয়া হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ও রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত ৩৭ হাজার ৬৮৮ জন রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ২০১ জন রোগী। জুন পর্যন্ত ছয় মাসে ভর্তি রোগী ছিল ৭ হাজার ৯৭৮ জন। এর মধ্যে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনে ভর্তি হয়েছিল ৬ হাজার ৭৯ জন। যদিও জুলাইয়ে (গতকাল পর্যন্ত) শুধু রাজধানীতেই রোগী ভর্তির সংখ্যা বেড়েছে ১৬ হাজার ২৭০ জন। সে অনুযায়ী শুধু চলতি বছরের হিসাবকে আমলে নিলেই রাজধানীতে জুলাইয়ের ২৫ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে রোগী ভর্তির হার বেড়েছে ২৬৭ শতাংশ।

বছরের প্রথম ছয় মাসে রাজধানীর বাইরে হাসপাতালে ভর্তি মোট রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৯৯ জন। জুলাইয়ের ২৫ দিনে ভর্তি হয়েছে ১৩ হাজার ৪৪০ জন। সে অনুযায়ী, শুধু চলতি বছর মোট আক্রান্তের হিসাবকে আমলে নিলে রাজধানীর বাইরে জুলাইয়ের ২৫ দিনে রোগী ভর্তির হার বেড়েছে প্রায় ৭০৮ শতাংশ। সে অনুযায়ী, জুলাইয়ের ২৫ দিনে রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোয় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়েছে আড়াই গুণেরও বেশি দ্রুতগতিতে। রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই ঢাকার বাইরে এখন দ্রুতগতিতে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন মনে করছেন, দেশে ডেঙ্গুর দ্রুত প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য যে আদর্শ পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল, তা নেয়া হয়নি।

বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চিকিৎসা ছাড়াও যেসব জনস্বাস্থ্যমূলক পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, সেগুলো ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে নেয়া হচ্ছে না। ফলে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর থেকে মশার মাধ্যমে অন্যদের শরীরে ডেঙ্গু ভাইরাস ছড়িয়ে যাচ্ছে। যারা আক্রান্ত কিন্তু ছিন্নমূল তাদের রাখতে হবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। যেসব রোগী ঝুঁকিপূর্ণ যেমন শিশু, গর্ভবতী, বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত ও বয়োবৃদ্ধ তাদের রাখতে হবে মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। যারা সংকটাপন্ন রোগী, তাদের রাখতে হবে টারশিয়ারি বা বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে। সবাইকেই মশারির মধ্যে রাখতে হবে। বাসায় যেসব রোগী রয়েছে, তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে। প্রতিনিয়ত নজরদারি করার দায়িত্ব আইইডিসিআরের। তবে প্রতিষ্ঠানটি এ কাজ করছে না। তারা ডেঙ্গুর সেরোটাইপের ওপর কাজ করেছে। সেটা সার্ভিল্যান্স নয়। একই সঙ্গে মশা নিধনের জন্য যে কীটনাশক প্রয়োগ করা হচ্ছে তার ওপরও সার্ভিল্যান্স প্রয়োজন। কেননা মশা হয়তো এ কীটনাশক প্রতিরোধের সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছে।’

যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) বলছে, রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য স্বাস্থ্যসেবার কাঠামো ব্যবস্থাপনা জরুরি। এ ব্যবস্থাপনাই সংক্রমণের বিস্তার রোধ করবে। জীবাণু ছড়ানো ও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য উপযুক্ত ভূমিকা রাখতে হবে। সংক্রমণের অনুমিত মাত্রার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় সতর্কতা হিসেবে আদর্শ পদক্ষেপ নিতে হবে। চিকিৎসা ছাড়াও রোগের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন বা নির্দেশিকা থাকতে হবে। স্থানীয় জনসাধারণ নিয়ে যারা কাজ করবেন তাদের প্রশিক্ষিত করতে হবে। রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন হলে জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রস্তুত রাখতে হবে। আক্রান্তদের মাধ্যমে যাতে সুস্থদের শরীরে রোগের সংক্রমণ না ঘটে, তার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা রাখতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে যাদের ভর্তি প্রয়োজনীয়তা নেই তাদের পর্যবেক্ষণ করতে হবে।

দেশে ডেঙ্গু রোগী ও মৃত্যুর যে তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দিয়ে থাকে তা পরিপূর্ণ নয়, বলে অভিযোগ রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, মূলত রাজধানী ঢাকার ২০টি সরকারি ও ৫৩টি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগী ও সব জেলা থেকে সরকারিভাবে পাওয়া তথ্যই প্রতিদিনের পরিসংখ্যানে প্রকাশ করা হচ্ছে। এর বাইরে অসংখ্য রোগী দেশের বিভিন্ন ক্লিনিক, ছোট-বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিলেও সে তথ্য নেই।

তথ্য পরিপূর্ণ না থাকায় দেশে ডেঙ্গুর প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য হলো সঠিক তথ্য রোগের বিরুদ্ধে কর্মকৌশল নির্ধারণে সাহায্য করে। কোনো রোগই হাসপাতালকেন্দ্রিক সীমাবদ্ধ নয়। হাসপাতালে বাইরে যেসব রোগী থাকছে তাদের পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে না। মশাবাহক রোগ নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি, এলাকাভিত্তিক রোগ ও রোগী ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং জনস্বাস্থ্য নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব রয়েছে। ফলে ডেঙ্গু এখন দেশের প্রধানতম সমস্যাগুলোর অন্যতম হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের শতাধিক দেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকলেও রোগীর অনুপাতে মৃত্যু বাংলাদেশে বেশি।

ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগে প্রতি বছর ৪০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলছে, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ এখন ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ও উপগ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ুতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ডেঙ্গুর জন্য নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। প্রাথমিকভাবে শনাক্তকরণ ও উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা রোগীকে সুস্থ করে তোলে ও মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘উষ্ণ বায়ুমণ্ডলীয় অঞ্চল হওয়ায় দেশে ডেঙ্গু বৃদ্ধি পেয়েছে। পরিবেশের পরিবর্তন হয়েছে। সারা বছরই বৃষ্টি থাকছে। শীতকাল নেই বললেই চলে। ফলে বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য বাহক মশাকে নির্মূল করতে হবে। এর জন্য পরিচালিত কার্যক্রমগুলোকে কার্যকরভাবে বাড়াতে হবে। কোনো ধরনের উপসর্গ দেখা গেলেই পরীক্ষা করতে হবে, যাতে দ্রুত চিকিৎসা শুরু ও রোগের বিস্তার প্রতিরোধ করা যায়। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জনসম্পৃক্ততা জরুরি। রোগ নিয়ন্ত্রণে জনস্বাস্থ্যমূলক কার্যক্রম একদিনের নয়। আগামী কয়েক দিন যদি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা কমে যায়, তাতে ডেঙ্গু নেই ভাবলে চলবে না। রোগ হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, হওয়ার পর সংক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা পরিপূর্ণভাবে থাকতে হবে। কিন্তু দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোয় জনস্বাস্থ্যমূলক কার্যক্রম অনুপস্থিত।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রাজধানীর সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ আগের চেয়ে উন্নত ও মানুষের যাতায়াতে কম সময় লাগে। এতে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ডেঙ্গু চিকিৎসার জন্য সরকারের সব পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান প্রস্তুত। চিকিৎসার গাইডলাইনও সময়োপযোগী করা হয়েছে। রোগীরা চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না এলে চিকিৎসা দেয়া ও পর্যবেক্ষণ করা কঠিন। রোগ ব্যবস্থাপনা ও মানুষকে সচেতন করতে স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, তথ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন বিভাগ একসঙ্গে কাজ করছে। রেড ক্রস, ইউনিসেফ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ডব্লিউএইচওসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেও সমন্বিত উদ্যোগ রয়েছে।’

গতকাল সন্ধ্যায় পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে এ পর্যন্ত ২০১ জন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছে, যার মধ্যে ১৬২ জন রাজধানী ও ৩৯ জন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিল। গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৪১৮ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে ১ হাজার ১৬২ এবং ঢাকার বাইরে ১ হাজার ২৫৬ জন। আর এ সময়ে ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।

Source: Bonik Barta

Share the Post: