আজ ২০ আগস্ট বিশ্ব মশা দিবস। ওয়ার্ল্ড মসকিটো প্রোগ্রাম বলছে, মানুষকে মশাবাহিত রোগের বিপদ ও বিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক প্রাণীর বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করছে এ দিবস। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীর যেকোনো প্রাণীর তুলনায় মশা বেশি মৃত্যু ও রোগের কারণ।
বিশ্বে মশাবাহিত রোগের ইতিহাস দেড় শতাব্দীর। বাংলাদেশে মশাবাহিত বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু থেকেই অল্পবিস্তর রয়েছে। তবে গত কয়েক দশকে মশাবাহিত কিছু রোগকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও সম্প্রতি ডেঙ্গু রোগ সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। এডিস মশাবাহিত এ রোগ দেশে দুই দশকের বেশি সময় ধরে মৃতের সংখ্যা বাড়িয়েছে। এতে সারা দেশে তৈরি হয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। সেই সঙ্গে উঠে এসেছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা। বিশ্বে অন্তত তিন হাজারের বেশি মশার প্রজাতি রয়েছে বলে জানিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্ল্ড মসকিটো প্রোগ্রাম ও যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা স্বাস্থ্য বিভাগ। এসব মশার মধ্যে একশ প্রজাতির মশা অন্তত ২০টি প্রাণঘাতী রোগ ছড়াতে সক্ষম। বাংলাদেশে ঠিক কত প্রজাতির মশা রয়েছে তার সঠিক গবেষণা না থাকলেও অন্তত শতাধিক প্রজাতি দেশে রয়েছে বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদরা।
সুইজ্যারল্যান্ডভিত্তিক বৈজ্ঞানিক জার্নাল এমডিপিআইয়ের ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ অ্যান্ড পাবলিক হেলথে প্রকাশিত গবেষণা বলছে, মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে প্রায়ই দেখা যায়। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে প্রতি বছরই ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। তবে বর্তমানে নতুন করে জাপানিজ এনকেফালাইটিস দেখা দিয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে ওয়েস্ট নাইল ও জিকা রোগও দেশে প্রবেশ করেছে।
বছরে সারা বিশ্বে সংক্রামক রোগে যত মৃত্যু হচ্ছে তার মধ্যে ১৭ শতাংশই মশাবাহিত বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। মৃতের এ সংখ্যা সাত লাখের বেশি। ডেঙ্গু হলো এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ানো সবচেয়ে সাধারণ ভাইরাল সংক্রমণ। বর্তমানে ১২৯টির বেশি দেশে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে আর মারা যাচ্ছে ৪০ হাজারের বেশি। বাংলাদেশে সাতটি মশাবাহিত রোগ রোগতত্ত্বের জায়গায় গুরুত্ব পেয়েছে বলে জানিয়েছে ডব্লিউএইচও, সিডিসি ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব রোগের মধ্যে ২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গুতে নিয়মিত আক্রান্ত হচ্ছে ও প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। ম্যালেরিয়া এখন দেশের ১৩টি জেলায় সংক্রমিত হচ্ছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় সর্বোচ্চসংখ্যক ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া যাচ্ছে, মৃত্যুও হচ্ছে এতে। কালাজ্বর ও জিকা এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলেও পীত জ্বর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর চিকুনগুনিয়ায় ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু হয়।
পৃথিবীতে অতি প্রাচীন একটি প্রাণী মশা। নানা প্রতিকূল পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে মশা টিকে আছে। তবে এ সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে মশার আচরণ। আগে এডিস মশা পরিষ্কার পানি ছাড়া ডিম পাড়ত না। কামড়াত শুধু সকালে ও সন্ধ্যায়। এখন এমনটি দেখা যাচ্ছে না। এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস মশার মধ্যে এলবোপিকটাস দূষিত ও নোংরা পানিতে জন্মাচ্ছে। রাত-দিন সবসময়ই কামড়াচ্ছে। রাজধানীতে যেসব এলাকায় ভবন নির্মাণ হচ্ছে তা যথাযথ নিয়ম মেনে হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন শহরে বহু জলাশয় রয়েছে, সেখানে মানবসৃষ্ট দূষণ হচ্ছে। যেমন রাজধানীর হাতিরঝিল। এখানে প্রচুর পরিমাণে মশার জন্ম হচ্ছে। এভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করছে জলাবদ্ধতা। যেগুলো পরিণত হচ্ছে মশার প্রজনন ক্ষেত্রে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছরে সারা দেশে মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু রোগ। গত ২২ বছরে দেশে সাড়ে তিন লাখের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আর মারা গেছে ১২ শতাধিক। ইউরোপীয় রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (ইসিডিসি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বে শতাধিক দেশে এ রোগের সংক্রমণ থাকলেও বাংলাদেশে রোগী মৃত্যুর হার বেশি। চলতি বছরে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে প্রায় ছয়জন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, মশাবাহিত রোগগুলো দেশে এখন আর মৌসুমি রোগে সীমাবদ্ধ নেই। বিশেষ করে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার সারা বছরই দেখা যাচ্ছে। ফলে এডিস মশা নির্মূলের ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক পন্থার যেসব ঘাটতি রয়েছে তার সমাধান প্রয়োজন। মূলত জলবায়ু পরিবর্তন, দ্রুত নগরায়ণ, মানুষের গতিশীলতা বৃদ্ধি, অনুপযুক্ত নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নিরক্ষরতা ও সচেতনতার অভাবের মতো বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশে মশাবাহিত রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে দেশে প্রথমবারের মতো চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয় ২০০৮ সালে। ২০১৭ সালে এ রোগ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে জাপানিজ এনকেফালাইটিসের উচ্চ প্রকোপ দেখা গেছে। আবার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মশাবাহিত স্থানীয় রোগে ভিন্নতা দেখা গেছে। দক্ষিণাঞ্চলীয় পার্বত্য অঞ্চল ম্যালেরিয়া-এন্ডেমিক, উত্তরাঞ্চলে বেশির ভাগ লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস দেখা যায়। তবে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ায় সারা দেশ সংক্রমিত হচ্ছে।
চলতি বছরের মে মাসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়াবিষয়ক তথ্যে দেখা যায়, ২০০৭ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সারা দেশে পৌনে ছয় লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। আর এর মধ্যে মারা গেছে অন্তত সাড়ে ছয়শ মানুষ।
কিউলেক্স মশার দুটি প্রজাতি ও ম্যানসোনিয়া মশা ফাইলেরিয়া রোগ ছড়াচ্ছে। দেশের অন্তত ৩৪টি জেলায় এ রোগ দেখা যাচ্ছে। আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশের মৃত্যু হয় বলে বৈশ্বিক বিভিন্ন জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্থা উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশকে জাপানিজ এনকেফালাইটিস রোগের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি।
দেশে বর্তমানে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও ম্যালেরিয়া মশাবাহিত রোগ হিসেবে রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ। বণিক বার্তাকে এ জনস্বাস্থ্যবিদ বলেন, ‘দেশে কালাজ্বর নিয়ন্ত্রণের পথে থাকলেও মাঝেমধ্যে কিছুটা দেখা যায়। তবে ম্যালেরিয়া এখনো রয়ে গেছে। পার্বত্য তিন জেলা বাদে বাকি জেলাগুলোয় প্রায় নির্মূলের অবস্থায় চলে এসেছে। আর জাপানিজ এনকেফালাইটিস দেশের কয়েকটি অঞ্চলে রয়ে গেছে। এসব রোগ ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা সৃষ্টি করেছে এডিস মশাবাহিত জিকা, চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু। দুই দশক ধরে আমরা ডেঙ্গুকে নির্মূল করতে পারিনি। এখন এ রোগ স্বাস্থ্য কাঠামোতে বড় চাপ তৈরি করেছে।’
তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলামের মতে মশাবাহিত রোগগুলোর মধ্যে বর্তমানে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়াই চিন্তার কারণ।