ওষুধ রফতানির ৩৭ শতাংশই বেক্সিমকো, স্কয়ার ও ইনসেপ্টার

দেশের ওষুধ শিল্পের বয়স প্রায় আট দশক। শিল্পটিতে এরই মধ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই তৈরি হচ্ছে। দেশের বাজারে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি বাড়ছে রফতানিও। গত অর্থবছরেও (২০২২-২৩) বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানি হয়েছে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর ৩৭ শতাংশই করেছে তিন প্রতিষ্ঠান—বেক্সিমকো, স্কয়ার ও ইনসেপ্টা।

বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানি শুরু হয় ১৯৮৫ সালে। এরপর গত কয়েক দশকে স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় ওষুধের বৃহত্তম উৎস হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি রফতানি হচ্ছে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোয়ও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওষুধ রফতানির বাজার আরো সম্প্রসারণের অনেক সুযোগ রয়েছে এখনো। অনুকূল রফতানি নীতি ও পদ্ধতি নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানির আয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফনের সম্ভাবনা রয়েছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ওষুধ রফতানি করছে ৪৬টি বাংলাদেশী কোম্পানি। গত অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ২ হাজার ২২ কোটি টাকার বেশি। এসব রফতানির ৩৭ শতাংশই করেছে বেক্সিমকো, স্কয়ার ও ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। এর মধ্যে সর্বোচ্চ রফতানি করেছে বেক্সিমকো ফার্মা। প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে ওষুধ রফতানি করেছে ২৭৫ কোটি টাকার বেশি। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস রফতানি করেছে প্রায় ২৪৯ কোটি টাকার ওষুধ। ২২৪ কোটি টাকার ওষুধ রফতানির মাধ্যমে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালস। এছাড়া রফতানির দিক থেকে শীর্ষ দশের তালিকায় থাকা অন্যান্য কোম্পানির মধ্যে রেনাটা প্রায় ২০৪ কোটি টাকার, একমি ১৫৩ কোটি, অ্যারিস্টোফার্মা ১৫২ কোটি, এসকেএফ ১২১ কোটি, জেনারেল ১১২ কোটি, বীকন ১১০ কোটি ও ওরিয়ন সাড়ে ৬১ কোটি টাকার ওষুধ রফতানি করেছে।

শীর্ষ ওষুধ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের চিফ অপারেটিং অফিসার রাব্বুর রেজা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ বছর বেক্সিমকো ফার্মা অষ্টমবারের মতো রফতানি স্বর্ণ পদকের জন্য মনোনীত হয়েছে, যা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরটি ফার্মা খাতের রফতানির জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। কভিড মহামারী-পরবর্তী পরিস্থিতি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের রফতানি গন্তব্য দেশগুলোর অর্থনীতিতে অনেক চাপ সৃষ্টি করেছে। এসব চাপ সত্ত্বেও গত অর্থবছরে বেক্সিমকো ফার্মার রফতানি বেড়েছে ৩ শতাংশ। প্রায় ১৭টি দেশে আমাদের নতুন পণ্য নিবন্ধন পেয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের রফতানি গন্তব্যগুলোর অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্থিতিশীল হয়ে উঠছে এবং চলতি অর্থবছরে আমরা রফতানি পণ্যের বিক্রি বাড়ার প্রত্যাশা করছি।’

ঔষধ প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় চাহিদার প্রায় ৯৮ শতাংশ পূরণের পর বিশ্বের অন্তত ১৫৭টি দেশে ওষুধ রফতানি করছে বাংলাদেশী কোম্পানিগুলো। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ ও নীতির ফলে ওষুধ রফতানি ও দেশীয় বাজারের আকার প্রতিনিয়তই বড় হচ্ছে। দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্তত ৫০টি বড় অংকের রফতানি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে দেশের অন্যতম শীর্ষ একটি ওষুধ কোম্পানির উদ্যোক্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যত দিন যাবে ওষুধ রফতানি তত বাড়বে। তবে যতদিন আমরা নিজেরা এপিআই (অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যালস ইনগ্রেডিয়েন্টস, ওষুধের উপাদান) তৈরি করতে পারব না, ততদিন পর্যন্ত প্রত্যাশা অনুযায়ী রফতানি বাড়বে না। ওষুধের কিছু কাঁচামাল আমরা তৈরি করতে পারছি। আরো কাঁচামাল তৈরি করতে পারলে রফতানি ত্বরান্বিত হবে। এছাড়া রফতানিসংক্রান্ত প্রক্রিয়াগুলো আরো সহজ করা প্রয়োজন।’

তথ্য অনুযায়ী এশিয়ার ৪৩টি, দক্ষিণ আমেরিকার ২৬, উত্তর আমেরিকার ছয়, আফ্রিকার ৩৯, ইউরোপের ৩৮ ও অস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি দেশে রফতানি হচ্ছে বাংলাদেশের ওষুধ। বর্তমানে সারা দেশে ২৯৫টি অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে প্রায় ৪৬ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল। এছাড়া দেশের ২৮৪টি ইউনানি ও ২০৫টি আয়ুর্বেদিক, ৭১টি হোমিওপ্যাথিক ও ৩১টি হার্বাল ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার ওষুধ উৎপাদন করছে।

তবে দেশের ওষুধ শিল্পকে রফতানি বাজার সম্প্রসারণের পথে এখনো অনেক প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালক (ফাইন্যান্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘‌ওষুধের বড় বাজার হলো ইউরোপ ও আমেরিকা। সেখানে জেনেরিক ওষুধের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক ভারত। সে তুলনায় বাংলাদেশের বাজার বড় নয়। রফতানিতে তারা যেসব সরকারি সুবিধা পায়, সেগুলো আমরা পাই না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তাদের প্রমোশনাল কার্যক্রম বেশি। আবার যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির আগে তারা এসে কারখানা পর্যবেক্ষণ করে যায়। এরপর তারা প্রতিটি ওষুধের জন্য আলাদা অনুমোদন দেয়। এতে অনেক বিনিয়োগ করতে হয়। আবার সে বিনিয়োগেও কর দিতে হয়। পণ্যের ক্লিনিক্যাল গবেষণা করতে হয়। দেশে এ গবেষণা করার মতো সংস্থা নেই। এজন্য ভারতের প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় বাজার ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য উৎপাদন খরচ এক নয়। এসব বিষয় বিবেচনা করতে হবে।’

প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতি বলছে, বাংলাদেশে যেসব ওষুধ তৈরি হচ্ছে তার প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে ওষুধ তৈরি ক্ষেত্রে নতুন মলিকিউল নিয়েও কোনো গবেষণা হচ্ছে না। অন্যদিকে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পেটেন্টকৃত ওষুধ উৎপাদনে ছাড় সুবিধা হারাবে। সেক্ষেত্রে পেটেন্টকৃত পণ্যের দাম বাড়বে। এতে বেশকিছু জটিল বায়োলজিকস দেশে উৎপাদন করার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি হবে।

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক এসএম শফিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ওষুধের কাঁচামাল তৈরির কাজ শুরু করেছিল। উৎপাদিত ওষুধের ২০ শতাংশ কাঁচামাল তারা তৈরি করত। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়ায় তা কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার এপিআই পার্ক তৈরি করেছে। এটি চালু হলে এ সমস্যার কিছু সমাধান হবে। পার্কে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কারখানা স্থাপন করেছে। তবে গ্যাসের অভাবে কারখানাগুলো চালু করা যাচ্ছে না। ওখানে প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় বিনিয়োগ রয়েছে। এখন ডলারের দাম বেশি। ফলে কাঁচামালের দামও বেড়েছে।’

দেশে ওষুধ রফতানিতে বাজার সম্প্রসারণ নিয়ে জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মুখপাত্র মো. নূরুল আলম বলেন, ‘দেশের বাইরে বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠানে আমাদের দেশে প্রস্তুতকৃত ওষুধের উপস্থাপন ভালো হওয়ায় রফতানি ত্বরান্বিত হচ্ছে। এছাড়া আমাদের রাষ্ট্রদূতরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের বিষয়ে আলোচনা করেন। কোনো কোনো ওষুধের জন্য আমার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সনদ পেয়েছি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) রফতানি প্রসারের জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছে। বিভিন্ন দুর্যোগে বাংলাদেশ থেকে ওষুধের অনুদান পাঠানো হয়। সেক্ষেত্রেও বাংলাদেশের ওষুধের ভাবমূর্তি বাড়ে। এতে সেসব দেশে ওষুধের বাজার তৈরি হয়।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: