বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় আশির দশকে। এরপর চর দশকের বেশি সময় কেটে গেলেও সরকারি পর্যায়ে এর চিকিৎসাসেবা তেমন এগোয়নি। দেশে এ রোগের চিকিৎসায় সর্বোচ্চ ও একমাত্র বিশেষায়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি (এনআইকেডিইউ)। প্রায় দুই যুগ আগে প্রতিষ্ঠিত ওই প্রতিষ্ঠানেও এখন পর্যন্ত কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে কেবল ৫০টির মতো। সরকারি অন্যান্য হাসপাতাল ও চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোয় এ সংখ্যা আরো নগণ্য।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনসের (বাউস) তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত তিন হাজারের কিছু বেশি রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দেশে। প্রথমবারের মতো প্রতিস্থাপন হয় ১৯৮২ সালে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই সময় চিকিৎসা কেন্দ্রটি পিজি হাসপাতাল নামে পরিচিত ছিল। যদিও তীব্র জটিলতার কারণে দেড় মাসের মাথায় ৩২ বছর বয়সী কিডনিগ্রহীতা ওই তরুণের মৃত্যু হয়। এরপর ছয় বছরের বিরতি দিয়ে ১৯৮৮ সালে আবারো তা শুরু হয় দেশের সর্বোচ্চ এ সরকারি চিকিৎসাসেবা কেন্দ্রে।
কিডনি রোগ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছরই দেশে কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। তবে যাদের অঙ্গটি পুরোপুরি অকেজো তাদের খুব কমসংখ্যকই চিকিৎসার আওতায় আসছেন। আবার যে-সংখ্যক কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে, তার খুব কমই হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায়। সমন্বয়হীনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রহের অভাবেই মূলত সরকারি হাসপাতালে এর হার অনেক কম।
সর্বসাধারণের জন্য কিডনি রোগের চিকিৎসা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০১ সালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র হিসেবে এনআইকেডিইউ প্রতিষ্ঠা করে সরকার। ১০০ শয্যায় রোগী ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সালে। পরে ২০১২ সালে হাসপাতালটিকে ১৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। গত বছরের জুলাইয়ে তা আরো বাড়িয়ে ৩০০ শয্যা চালু হয়। এর কিছুদিন পর ৫০০ শয্যার প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়া হয়। যদিও বর্তমানে ৩০০ শয্যায় রোগী ভর্তির সুবিধা রয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটিতে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন হয় ২০০৫ সালের এপ্রিলে। এরপর দুই বছর বিরতি দিয়ে ২০০৮ সালে চারটি, ২০০৯ সালে আটটি, ২০১০ সালে চারটি, ২০১১ সালে পাঁচটি, ২০১২ ও ২০১৩ সালে তিনটি করে, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে একটি করে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়। এরপর পাঁচ বছর সে কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। ২০২১ সালে তা আবার শুরু হলে ওই বছর কিডনি প্রতিস্থাপন হয় মোট তিনজন রোগীর। এছাড়া ২০২২ সালে পাঁচটি, ২০২৩ সালে ১১টি এবং সর্বশেষ গত ২০ জানুয়ারি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে একজনের কিডনি। সে হিসেবে শুরু থেকে এ পর্যন্ত ৫০ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে সরকারের বিশেষায়িত এ সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান।
হাসপাতালটির পরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির জনবল সংকট তীব্র। ১৫০ শয্যার হাসপাতাল অনুসারে চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য জনবলের জন্য ৬৬০টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। নতুন করে শয্যা বাড়লেও পদের অনুমোদন হয়নি। আগের পদের মধ্যেও শতাধিক শূন্য। ১৩২টি চিকিৎসক পদের বিপরীতে রয়েছেন ১০৬ জন। তবে ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল পরিচালনার জন্য প্রায় ২ হাজার ৭০০ জনবল প্রয়োজন বলে মনে করেন পরিচালক ডা. বাবরুল আলম।
গত রবি ও মঙ্গলবার হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, চারতলাবিশিষ্ট হাসপাতাল ভবনটিকে সম্প্রসারণ করা হয়েছে আটতলা পর্যন্ত। পঞ্চম তলায় নতুন করে স্থাপন করা হয়েছে ১০ শয্যার রেনাল নিবিড় পরিচার্য কেন্দ্র (আরআইসিইউ)। তবে আইসিইউ বিশেষজ্ঞের সংকটসহ নানা কারণে চালু রাখা হয়েছে কেবল পাঁচটি শয্যা। কিডনি রোগীদের জন্য অতিগুরুত্বপূর্ণ রোগ নির্ণয় পদ্ধতি টিস্যু ক্রস ম্যাচিং ও হিউম্যান লিউকোসাইট অ্যান্টিজেন (এইচএলএ) টাইপিং, যা এ হাসপাতালে হয় না। এসব পরীক্ষার প্রয়োজন হলে রোগীকে অন্য কোনো সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে হয়।
এনআইকেডিইউর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. বাবরুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি পরিচালকের দায়িত্ব নেয়ার পর নারী ও পুরুষ আলাদা করে ২০ শয্যার ট্রান্সপ্লান্ট ইউনিট চালু করেছি। যাদের ট্রান্সপ্লান্ট হবে তাদের এখানে বিশেষ যত্নে রাখা হয়। জরুরি বিভাগে অস্ত্রোপচারের কক্ষ চালু করা হয়েছে। স্থাপন করা হয়েছে অক্সিজেন প্লান্ট। আমাদের এখানে শুধু রোবোটিক সার্জারি বাদে সবকিছুই হচ্ছে।’
দুই দশকেও এত কম রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপনের বিষয়ে ডা. মো. বাবরুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের সার্জন খুবই কম। সারা দেশে সব মিলিয়ে সার্জন রয়েছেন মাত্র ১০-১২ জন। আগে এ হাসপাতালে প্রতিস্থাপন কম ছিল। তবে এখন গতি বেড়েছে। প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি করে প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। এজন্য এখন পরিপূর্ণ চিকিৎসক দল গঠন করা হয়েছে। যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে হয় না তা সর্বোচ্চ দুই মাসের মধ্যে চালু করা হবে। তবে আইসিইউর জন্য আলাদা লোকবল প্রয়োজন, এ সংকটও দ্রুত কেটে যাবে।’
দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও এনআইকেডিইউ ছাড়াও আরো আটটি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কিডনি প্রতিস্থাপন হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতিস্থাপন করেছে সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতাল। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির এ সংখ্যা দেড় সহস্রাধিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করেছে ৬২৫টি। এছাড়া বাংলাদেশ কিডনি ফাউন্ডেশন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল ও পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কিডনি প্রতিস্থাপন করছে। যদিও পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে পপুলারে সেবাটি বন্ধ রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে দেশে প্রথমবারের মতো ক্যাডাভেরিক কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়। স্ট্রোক, মস্তিষ্কে আঘাত, মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার বা অন্য কোনো কারণে যদি মানবদেহের ব্রেন স্টেমের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় তখন তাকে বলা হবে ব্রেন ডেথ। অর্থাৎ ব্রেন ডেথ এক রোগীর দেহ থেকে কিডনি নিয়ে অন্য একজনের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয় এ পদ্ধতিতে। অস্ত্রোপচারটির নেতৃত্ব দেন বিশ্ববিদ্যালয়টির ইউরোলজির অধ্যাপক ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোলজিক্যাল সার্জনসের সাবেক সভাপতি ডা. মো. হাবিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে এ পর্যন্ত সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে তিন হাজারের কিছু বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। প্রতিস্থাপনের জন্য বড় ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছি। সাধারণ মানুষের সক্ষমতার মধ্যে এটি আনতে সরকারি ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আমাদের এখানে সপ্তাহে একটা কিডনি প্রতিস্থাপন হয়। কোনো কোনো সপ্তাহে দুটিও হয়। তবে বিএসএমএমইউ সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে এ সেবা চালু হলে সপ্তাহে প্রায় চারটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে। আমাদের হাসপাতালে সবসময় ৬০-৭০ জন রোগী কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ থাকে।’
তিনি জানান, বিএসএমএমইউতে প্রতিস্থাপনের জন্য রোগীর খরচ হচ্ছে ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। আর বিএসএমএমইউ সুপার হাসপাতালে এ খরচ হবে ৩ লাখ টাকার কিছু বেশি। সরকারি হাসপাতালে খরচ আরো কম। তবে বেসরকারি পর্যায়ে হাসপাতালভেদে ন্যূনতম ১০-১৫ লাখ টাকা খরচ হতে পারে।
এনআইকেডিইউ দুই বছর আগে জানিয়েছিল, দেশে দুই কোটি মানুষ দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত। এর মধ্যে বছরে ৩৫-৪০ হাজার মানুষ রোগটির শেষ পর্যায়ে (পঞ্চম স্তর) পৌঁছে যায়। অর্থাৎ তাদের জন্য কিডনি প্রতিস্থাপনের বিকল্প নেই।
দেশে সবচেয়ে বেশি কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন সেন্টার ফর কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক ডা. কামরুল ইসলাম। তিনি বিনা পারিশ্রমিকে দেড় সহস্রাধিক কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এ চিকিৎসক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রসারের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। ন্যূনতম ত্রুটি রোগীর জীবন সংকটে ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞের সংকট রয়েছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তাই এ সেবা শুরুর কিছুদিন পর আবার বন্ধ করে দিয়েছে। কিডনি প্রতিস্থাপন প্রসারের জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।’
আট বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে হৃদরোগ, ক্যান্সার, কিডনির চিকিৎসা বিশেষায়িতভাবে শুরু করার জন্য প্রকল্প চলমান রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আগের তুলনায় দেশে এসব চিকিৎসা এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। কিডনি, লিভার প্রতিস্থাপনের মতো বিষয়গুলো ব্যয়বহুল। তবে এ নিয়েও সরকার কাজ করছে। দুই-এক বছরের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আমরা দেখতে পাব।’