গঙ্গা দিয়ে উজান থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক আসছে বাংলাদেশে

ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যে হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের ওপর দিয়ে গঙ্গা নদী পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। এর একটি ধারা মহানন্দার সঙ্গে মিলিত হয়ে পদ্মা নামে বাংলাদেশে প্রবেশ করে, যা রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক এ নদী উজান থেকে বয়ে আনছে প্লাস্টিকের অসংখ্য ক্ষুদ্র কণা। নদীর প্রবাহে মিশে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেশে। পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য যা মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। ভারত ও বাংলাদেশের গবেষকদের করা পৃথক দুটি গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।

নেদারল্যান্ডসভিত্তিক জার্নাল সংস্থা এলসিভিয়ারের ইকোটক্সিলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সেফটিতে সম্প্রতি ‘ডিস্ট্রিবিউশন অব মাইক্রোপ্লাস্টিকস ইন সোরিলেন ওয়াটার অ্যান্ড সেডিমেন্ট অব দ্য গাঙ্গেস রিভার বেসিন টু মেঘনা ইসটুয়ারি ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গবেষণাপত্র প্রকাশ পেয়েছে। সীমান্তবর্তী চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে চাঁদপুরের মেঘনার মোহনা পর্যন্ত ৩০টি স্থানের পানি ও পলির নমুনা নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে। তাতে দেখা যায়, ভারতের সীমান্ত থেকে ব্রহ্মপুত্রের সংযোগ পর্যন্ত পদ্মার উজান এবং সেখান থেকে চাঁদপুরে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত সব জায়গায়ই প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি।

গবেষক দলের অন্যতম একজন ছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শফি মুহাম্মদ তারেক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘গঙ্গা বা পদ্মা নদী অনেক শহর ও শিল্প নগরী পেরিয়ে এসেছে বলে এতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। ভারতের অংশেও এমন অবস্থা বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। নদীর বাংলাদেশের উজানের অংশে নাকি ভাটিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক বেশি, আমরা তা দেখার চেষ্টা করেছি। গবেষণায় বিভিন্ন রং ও আকারের প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা পেয়েছি। মাইক্রোপ্লাস্টিকের হারও বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের।’

গবেষণায় বলা হয়, উজানের প্রতি লিটার পানিতে সর্বনিম্ন ১৪ দশমিক ৩ থেকে সর্বোচ্চ ১০৭ দশমিক ৩টি পর্যন্ত ক্ষুদ্র কণা (পার্টিকেল, যা ৫ মিলিমিটারের ছোট) পাওয়া গেছে। অর্থাৎ গড়ে ৫০ দশমিক ৯টি। আর ভাটির অংশের প্রতি লিটার পানিতে গড়ে ৬৪টি ক্ষুদ্র কণা মিলেছে। একইভাবে উজানের প্রতি কেজি পলিতে প্লস্টিকের ক্ষুদ্র কণার পরিমাণ ছিল ৮২৩ থেকে ৬ হাজার ১৪৩টি। গড়ে ২ হাজার ৯৫৩টি। আর ভাটির অংশে প্রতি কেজি পলিতে ১ হাজার ৪৫৬ থেকে ৬ হাজার ৪৭৬ ক্ষুদ্র কণা পাওয়া গেছে, যা গড়ে ৪ হাজার ১৪। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক ছিল আট রঙের।

মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকারকে ৪ থেকে ৫, ২ থেকে ৪, ১ থেকে ২, শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১, শূন্য দশমিক ১ থেকে শূন্য দশমিক ৫ ও শূন্য দশমিক ১ মিলিমিটারের ছোট ধরে ভাগ করা হয়। আকারভেদে এসব ক্ষুদ্র প্লাস্টিক প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য বেশ ক্ষতিকর। উজানের অংশের পানিতে সবচেয়ে বেশি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যায় শূন্য দশমিক ১ থেকে শূন্য দশমিক ৫ মিলিমিটার আকারের। ৩৫ শতাংশই ছিল এ আকারের। আর ২১ শতাংশ শূন্য দশমিক ১ মিলিমিটারের ছোট, ১২ শতাংশ করে ১ থেকে ২ মিলিমিটার ও শূন্য দশমিক ৫ থেকে ১ মিলিমিটার, ১১ শতাংশ ২ থেকে ৪ মিলিমিটার ও ৮ শতাংশ ৪ থেকে ৫ মিলিমিটার আকারের। একইভাবে ভাটির অংশের পানিতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় শূন্য দশমিক ১ থেকে শূন্য দশমিক ৫ মিলিমিটার আকারের। যা সর্বমোট মাইক্রোপ্লাস্টিকের ২৬ শতাংশ। উজান ও ভাটির পলিতে সবচেয়ে বেশি পাওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার যথাক্রমে ৩৬ ও ৩৩ শতাংশ (শূন্য দশমিক ১ মিলিমিটারের কম)।

পাঁচ ধরনের প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা নদীর পানি ও মাটিতে পাওয়া গেছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। এগুলো হলো প্লাস্টিকের আঁশ, খণ্ডিত অংশ, পাতলা আবরণ, ক্ষুদ্রাকৃতির শোলা ও অতিসূক্ষ্ম বল। কোনো কোনো স্থানে পানি ও পলিতে ছোট দানাও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উজান অংশে বেশি পাওয়া গেছে খণ্ডিত অংশ, প্রায় ৪৪ শতাংশ। এরপর প্লাস্টিকের আঁশ পাওয়া গেছে ৪১ শতাংশ, পাতলা আবরণ ও সূক্ষ্ম বল ৬ শতাংশ করে এবং শোলার ক্ষুদ্রাংশ মিলেছে ৩ শতাংশ। একইভাবে ভাটির পানিতেও প্লাস্টিকের খণ্ডিত অংশ বেশি ছিল, যা ৪১ শতাংশ। অন্যান্য প্লান্টিকের ক্ষুদ্র কণার মধ্যে আঁশ ৩১ শতাংশ, ১৮ শতাংশ পাতলা আবরণ, ৬ শতাংশ বল ও ৪ শতাংশ শোলা ছিল গবেষণার নমুনা পানিতে। উজানের অংশের পলিতেও প্রচুর পরিমাণে খণ্ডিত কণা (৪৫ শতাংশ) পাওয়া গেছে। অন্যান্যের মধ্যে আঁশ ৩২ শতাংশ, পাতলা আবরণ ৯ শতাংশ, বল ৮ শতাংশ এবং শোলা ও দানা ছিল ৩ শতাংশ করে। আর নদীর ভাটি অংশের পলিতে আঁশ মিলেছে ৪৬ শতাংশ। এছাড়া খণ্ড ২৫ শতাংশ, পাতলা আবরণ ১২, দানা ৮, বল ৭ ও শোলা ৩ শতাংশ পাওয়া গেছে।

গবেষকরা বলছেন, বেশির ভাগ মাইক্রোপ্লাস্টিক ছিল ছোট কণা, যা গঙ্গা নদীর অববাহিকায় সময়ে সময়ে প্লাস্টিকের দূষণ বৃদ্ধি করছে। মানুষের ফেলে দেয়া পাতলা প্লাস্টিকের প্যাকেজিং ফিল্ম, ব্যাগ, প্যাকেজিং সামগ্রী ফেলে দেয়া প্লাস্টিকের আবর্জনা, ত্বকের যত্নের পণ্য—এসব বিভিন্ন প্লাস্টিক থেকে এসব এসেছে। কাপড় ধোয়ায় ব্যবহার করা সামগ্রী থেকেও এসেছে কিছু কিছু।

গঙ্গার পানি ও পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে এক বছর আগে ভারতের গবেষকদের করা একটি গবেষণাও এলসিভিয়ারে প্রকাশিত হয়েছে। ‘ফাই রিপোর্ট অন মাইক্রোপ্লাস্টিক ইন ট্রিবিকারিস অব দি আপার গঙ্গা রিভার অ্যালোং দিহরাদুন ইন্ডিয়া: কোয়ালিটেটিভ ইস্টিমেশন অ্যান ক্যারেক্টারাইজেশনস’ শিরোনামের গবেষণায় ভারতের দেরাদুনে গঙ্গা নদীর উপনদীর (সুসওয়া, রিসপানা ও বিন্দাল) পানি ও পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি তুলে ধরা হয়। এতে নমুনা সংগ্রহের স্থানগুলো থেকে প্রতি কেজি পলিতে গড়ে ৭ হাজার ২০০ থেকে ১৬ হাজার ৪০০ প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা পাওয়া গেছে। আর প্রতি লিটার পানিতে মিলেছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার ২০০ ক্ষুদ্র কণা। পানিতে ৪১ শতাংশ প্লাস্টিকের আঁশ ও পলিতে ৩৮ শতাংশ খণ্ডিতাংশ পাওয়া গেছে।

পরিবেশে মাইক্রোপ্লাস্টিক একটি ‘উদীয়মান’ দূষণ, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য তীব্র উদ্বেগের কারণ বলে উল্লেখ করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি বলছে, মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার সংস্পর্শে মানবস্বাস্থ্যের প্রভাব রয়েছে। পরিবেশ, খাদ্য, পানি ও বাতাসের মাধ্যমে এগুলো মানবদেহে প্রবেশ করে। তাছাড়া পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিক পদার্থের ঘনত্ব, সময়কাল ও অবক্ষয় মাত্রার ওপর ভিত্তি করে ভাসতে বা ডুবতে পারে। এর সঙ্গে যুক্ত রাসায়নিক জলজ প্রাণীর জন্যও বিপজ্জনক। এগুলো বাস্তুতন্ত্র, জীববৈচিত্র্য ও মানবস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে।

পরিবেশে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা এবং পরিবেশের অন্যান্য বিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এএসএম সাইফুল্লাহ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যে দৈনন্দিন প্লাস্টিক ব্যবহার করি তা ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। ব্যবহার্য প্লাস্টিক ফেলে দেয়ার পর কোনো না কোনো উপায়ে শেষ পর্যন্ত নদীতে গিয়ে পড়ে। আর উজানে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকলে স্বাভাবিকভাবে তা ভাটি অঞ্চলে আসবে। একই সঙ্গে ভাটিতে থাকা প্লাস্টিকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরিমাণ বৃদ্ধি করে। শুধু মাটি বা পানিতে নয়, ক্ষুদ্রাকৃতির প্লাস্টিক মাছেও পাওয়া গেছে। রং, আকার ও ধরন অনুযায়ী মাইক্রোপ্লাস্টিকের ক্ষতির প্রভাব ভিন্ন হতে পারে। কেননা তাতে বহু রাসায়নিক থাকে। একটা প্লাস্টিকে অন্তত ১৩ হাজার রাসায়নিক থাকতে পারে।’

তার মতে, বর্তমানে যেভাবে পুনর্ব্যবহারের জন্য প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। কেননা তা রং ও ধরন অনুযায়ী আলাদা করা হয় না। ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম উন্নত বিশ্বেও সঠিকভাবে হচ্ছে না। পুরনো প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাত করে আবার ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত করা হয়। তাতে আবারো নতুন করে রাসায়নিক যুক্ত করা হয়। পরিবেশের ক্ষতি করলে জনস্বাস্থ্যের স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতি হবে। চক্রাকারে এ দূষণের বিষয়টি ঘুরতে থাকে।

পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট (ইলেক্ট) অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাইক্রোপ্লাস্টিকের আরো ক্ষুদ্র কণা রয়েছে, তা হচ্ছে ন্যানোপ্লাস্টিক। এ প্লাস্টিক খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। বাতাসে যাচ্ছে। এরপর মানুষের ফুসফুস ও রক্তে মিশে যাচ্ছে। ফুসফুসে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ হতে পারে এ ন্যানোপ্লাস্টিক। এগুলোর মধ্যে ক্ষতিকর অনেক রাসায়নিক আছে। মানবদেহের রক্তে মাইক্রো ও ন্যানোপ্লাস্টিক মিশে গেলে শুধু যে একটি রোগ হবে তা নয়, তা বিভিন্ন রোগের কারণ হতে পারে। এতে হরমোনার পরিবর্তনও হতে পারে। ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে।’

Source: Bonik Barta

Share the Post: